একশত চল্লিশ বছর আগে ১৮৮৬ সালে ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিতে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকরা সর্বাত্মক ধর্মঘটে সামিল হয়। ৪ঠা মে ধর্মঘটের সমর্থনে শ্রমজীবি মানুষের বিশাল সমাবেশ পন্ড করতে পুলিশ ও মালিকদের লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডাবাহিনী নৃশংস আক্রমন চালায়। এই আক্রমনে শত শত শ্রমিক নিহত আহত হন। বহু শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রহসন মূলক বিচারে ৯জন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।
সময়টা ছিলো ইউরোপের ২য় শিল্প বিপ্লবের যুগ। বৃটিশসহ ইউরোপের কতিপয় দেশ এশিয়া আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশ দখল করে সে সব দেশের সম্পদ লুন্ঠন করে ইউরোপের দেশ সমূহ সম্পদশালী ও উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিক হয়। বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পদ লুট করে নিজ দেশে কলকারখানা বিস্তার শুরু করে। এসময় বৈদ্যুতিক শক্তি, স্টিম ইঞ্জিনসহ কতিপয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এর ফলে শিল্প বিকাশ দ্রুত হয়। বৈদ্যুতিক শক্তি পেশি শক্তির জায়গা দখল করে। এইসব শিল্প কারখানা পরিচালনার জন্য স্বাধীন কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে কলকারখানায় কাজ করতে বাধ্য করে। মেশিনের সাথে তাদের জীবন ছিলো বাঁধা। তারা ছিলো ইউরোপের শ্রমিক শ্রেনীর প্রথম জেনারেশন। তাদের ১৫–১৬ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা হতো। বিশ্রাম বিনোদন বলতে শ্রমিকদের কিছুই ছিলো না। পারিবারিক জীবন থেকে তারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শ্রমিকের উদয়াস্ত খাটুনির ফলে মালিকের মুনাফা বৃদ্ধি পায়। যত বেশি শ্রম তত বেশি মুনাফা।
উপনিবেশিক শক্তি ভারতীয় উপমহাদেশে পুঁজি লুন্ঠনের স্বার্থে রেল, স্টিমার, কয়লা খনি, চা বাগান, পাট ও সুতাকল সমূহ গড়ে তোলে। এইসব শিল্প কারখানায় শ্রমিক হিসাবে কাজ নেয় দেশের উদ্বৃত্ত কৃষি শ্রমিক এরাই ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রথম জেনারেশন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের পাকিস্তানি মালিকানাধীন সকল শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করা হয়। এছাড়াও বাঙ্গালি মালিকানাধীন কয়েকটি পাটকল, সুতাকল, ব্যাংক জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৬৯ সালের গন অভ্যুত্থানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে মূল দাবি ছিল ‘পশ্চিমা শোষণ বন্ধ করার জন্য ব্যাংক বিমা, ভারি শিল্প জাতীয়করণ করতে হবে। স্বাধীনতার পর সরকারী নীতিতে তার প্রতিফলন ঘটে।
পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাংলাদেশের পাটের রপ্তানি আয়ের ৮৬ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানের শিল্পায়নের জন্য ব্যয় করা হতো। পাকিস্তানের ২২ পরিবার বাংলাদেশে পাটকল, সুতাকল ও ব্যাংক সমূহের মালিকানায় ছিলো। হাতে গোনা কয়েকজন বাঙ্গালি উদ্যোক্তা শিল্প কারখানা স্থাপনের সীমিত সুযোগ পায়।
স্বাধীনতার পর বাঙালি নব্য ধনিকরা শিল্প কারখানা জাতীয়করণের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দর্শনকে মেনে নিতে পারেনি। প্রথম থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সমূহ করায়ত্ত করে ব্যাংকে ঋণ দিয়ে একদল লুটেরা পুঁজির মালিক তৈরির প্রক্রিয়া। ৮০ দশকে সোভিয়েতের পতনের পর এই প্রক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান পানির দরে কিনে নেয় নব্য লুটেরা পুঁজির মালিকরা। ক্রমান্বয়ে শাসক গোষ্ঠীর মদতও লাভ করে তারা। এভাবে ঘুষ, দুর্নীতি, লক্ষ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ লোপাট, বিদেশে পুঁজি পাচারের সুযোগ দিয়ে স্বজনতোষি পুঁজিবাদ গড়ে তোলা হয়। রপ্তানিমুখি শ্রমঘন গার্মেন্টস শিল্প দ্রুত মুনাফা অর্জনের একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। একই সাথে সিরামিক, রাবার, চামড়া শিল্প, ঔষধ শিল্প, বড় বড় নির্মাণ ডেভোলপার কোম্পানি গড়ে ওঠে। নতুন জেনারেশনের শ্রমিক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৫ লক্ষ (বাংলাদেশ শ্রম শক্তি জরীপ–২০২৩ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) কিন্তু সে পরিমাণ কর্মসংস্থান নেই, উল্টো প্রতি বছর নতুন ২০/২২ লক্ষ শ্রম শক্তি শ্রমের বাজারে প্রবেশ করছে। উপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকায় দক্ষ শ্রম শক্তির অভাবে তাদের একটা বড় অংশ বেকার, প্রচ্ছন্ন বেকার বা অর্ধ বেকার থেকে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০২৪ (৩য় কোয়ার্টারে) তথ্য মতে বাংলাদেশে এখন ২৫ লক্ষ ৫০ হাজার শ্রম শক্তি বেকার। অর্থাৎ বেকারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা দুর্নীতি ইত্যাদির ফলে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের বিনিয়োগ হচ্ছে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখিনতা, রপ্তানীযোগ্য পণ্যের এক মুখিতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা উন্নয়নশীল আমাদের দেশের কর্মসৃজনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিগত শতাব্দীর সাতের দশক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ শুরু হয়। ৮০’র দশক থেকে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে রাষ্টায়ত্ব মিল কারখানা প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়ে একদল নতুন শিল্প মালিক গজিয়ে উঠে। এরা বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা পেয়েছে। এক পর্যায়ে এসব রাষ্ট্র্র সহায়তায় গজিয়ে উঠা শিল্প মালিকরা রাজনৈতিক ক্ষমতাও কুক্ষিগত করে নেন। এদের অনেকে পুঁজি পাচারের সাথে জড়িত বিদেশে শত লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছে। ক্রমান্বায়ে ৩০ লক্ষ শহীদের জীবনের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে সংবিধানের মৌলিক আদর্শকে পাশ কাটিয়ে দেশে স্বজনতোষী লুটেরা পুঁজিতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্যতিক্রম যে নাই একথা বলছি না। বিশ্ব এখন দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের যুগ পার হয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন কায়িক, মানষিক ও বৌদ্ধিক শ্রমের জায়গা দখল করেছে। অথচ আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি।
প্রয়োজনীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে আমাদের দেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে তাল রেখে চলতে পারছে না। কারণ আমাদের দেশের অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ।
দুর্ভাগ্যের বিষয় প্রায় দুই শতাব্দী ধরে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করে জীবন দিয়ে সংগঠন করার অধিকার আদায় করেছে। অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, দরকষাকষির অধিকার ইত্যাদি অর্জন করেছে।
কিন্তু আমাদের দেশের মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী এখনও পাল্টাতে পারেননি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা অনেক সীমিত। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক সংখ্যা শতকরা ১৪ জন। বাকী ৮৬ ভাগ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ট্রেড ইউনিয়নে যে দুরবস্থা সেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কথা বলা বাহুল্য। সংগঠিত হওয়ার অধিকার, দরকষাকষির অধিকার এই খাতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
অথচ স্বাধীনতার পর প্রণীত সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “কৃষক শ্রমিকের মুক্তি রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে– মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষন হইতে মুক্তি দান করা।”
আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের সামনে সংকটগুলো বহুমুখী। বেকারত্ব, জীবনধারনের মান অনুযায়ী মজুরী না পাওয়া, ১৫/১৬ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য হওয়া, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি বিষয়সমূহ শ্রমজীবি মানুষের জীবনকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। গোঁদের উপর বিষফোড়ার মত তীব্র বেকারত্ব দেশের সাধারণ মানুষকে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে বাধ্য করছে। মে দিবসের মূলদাবি ৮ ঘন্টা কাজের সাথে জবরদস্তী মুলক অতিরিক্ত কর্মঘন্টা সমঞ্জস্য মূলক নয়। দীর্ঘ ২ শতাব্দীর শিক্ষা হলো সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ছাড়া মুনাফালোভী মালিকদের কাছ থেকে জীবন ধারণ অনুযায়ী মজুরী, অবাধে সংগঠিত হওয়া, দর কষাকষির অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। অথচ লুটেরা ধনিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী কিছু ভইফোর সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নকে রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে বিভক্তি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সম্প্রতি অন্তবর্তী সরকার শ্রম জগতের এইসব অসামঞ্জস্যতা অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান শ্রম আইন সংশোধনসহ একটি সুসংবদ্ধ শ্রমিক ও শিল্প বান্ধব সুপারিশ প্রণয়নের জন্য “শ্রম সংস্কার কমিশন” গঠন করেছে। কমিশন বিগত পাঁচ মাস যাবৎ বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমজীবী মানুষ, মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন সহ আই.এল.ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, দেশের সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের সাথে মত বিনিময় করেছে। এইসব পরামর্শ সভায় আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সংগঠিত হওয়ার অধিকার, দরকষাকষি করার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন সম্পর্কে পরামর্শ এসেছে।
বিদ্যমান শ্রম আইন শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে না। এই আইনের স্থলে শ্রমবান্ধব আইন প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক–অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয়ক্ষেত্রে সকল শ্রমিকের জীবন ধারণ মান অনুযায়ী মজুরী নির্ধারণের পরামর্শ এসেছে। এই সব পরামর্শের ভিত্তিতে শ্রম কমিশন দেশের প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল শ্রমিকদের সরকারী তথ্য ভান্ডারে নিবন্ধিত করা, স্থায়ী জাতীয় নিম্নতম মজুরি কমিশন গঠন, আই.এল.ও কনভেনশনের সাথে সমঞ্জস্যপূর্ণ শ্রম আইন প্রনয়ন, দুর্ঘটনায়া ক্ষতিপূরণ প্রদান, আউটসোর্সিং শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ সহ সকল সুবিধা নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মে দিবসের শিক্ষা গ্রহণ করে সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলা সময়ের দাবি। দুনিয়ার মজদুর এক হও। মহান মে দিবস অমর হোক।
লেখক : সদস্য, শ্রম সংস্কার কমিশন ও সভপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টি ইউ সি), চট্টগ্রাম।