বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতি সাবজেক্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো দেশের উন্নয়ন, অনুন্নয়ন, আর্থিকখাত, জীবনযাত্রা নির্বাহের মান ইত্যাদি আলোচনা করতে হলে অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরকে নিয়ে আলোচনা করতে হয়। বাংলাদেশ যে মুহুর্তে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করবে সেই মুহুর্তে একটি অনিবার্য ঘটনা ঘটে গেল। পূর্ববর্তী সরকার অর্থনীতির অধিকাংশ খাতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগালেও কোনো খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অরাজকতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, উৎকোচ না দিলে বা না পেলে কোনো কাজই হতো না। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চিত অর্থ কিভাবে অল্প সংখ্যক ব্যক্তি হস্তগত করে তার উজ্জ্বল প্রমাণ এ সেই বাংলাদেশ। এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থকে সঞ্চয় আকারে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করার জন্য যে শ্রেণির ব্যাংক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তা হলো বাণিজ্যিক ব্যাংক। অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের একটি সংজ্ঞা আছে। যে ব্যাংক জনগণের নিকট থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থ সংগ্রহ করে এবং অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য জনগণকে ঋণ আকারে প্রদান করে, সেই ব্যাংকগুলো হয় বাণিজ্যিক ব্যাংক। এ সংজ্ঞাটি হয় ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের সংজ্ঞা। আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক হচ্ছে এমন একটি ব্যাংক যা মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। ফলে মুনাফা করার উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক সমূহ নিজদের কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করে। তাছাড়া এই ব্যাংকগুলো পরিচালনা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নামক একটি ব্যাংক আছে যাকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অভিভাবক বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা অভিভাবক ব্যাংকের নির্দেশনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়। যে কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার বাইরে চলে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উক্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রাখে। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সব বাণিজ্যিক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানেনি সেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেয়ার আওতায় এনেছিল কিনা– তা বিবেচনা করা প্রয়োজন। যদি তখনকার সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা অবাধ্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে কোন একশন বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয় তবে বলা যায়, এসব বাণিজ্যিক ব্যাংক বিপর্যস্ত হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঐসব কর্তা ব্যক্তিরাই দায়ী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঐসব কর্তা ব্যক্তিরা দায়িত্ব এড়াতে পারে না। কোনো কোনো পত্রিকার খবরে দেখা যায়, ঐ সময়ের দায়িত্ব নিয়োজিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তা ব্যক্তিরা বলেছেন তারা নাকি সরকারের জন্য পারেনি। অফিস মুখের কথায় চলে না। তারা এ ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা দেখাতে পারে। আর যদি সরকারি নির্দেশনা দেখাতে না পারে তবে প্রতিটি দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিদের এর দায় নিতে হবে। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা না করে শুধু পূর্ববর্তী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর উপর দোষ চাপাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়েই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন ব্যাংক ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। আর এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠি এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে ঐ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা রেখেছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে এক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন এক সার্কুলার জারি করেছিল যে, প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংক এক ডিজিট এর ওপর মুনাফা (সুদ) দিতে পারবে না। ফলে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক নয় শতাংশের ওপর মুনাফা প্রদান করেনি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক মেনে চলেছে। যদি তাই সত্য হয় তবে এখন যে সব বাণিজ্যিক ব্যাংক দুর্বল বা বিপদে পড়েছে সেই সব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কারণ এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠি কোনো রাজনীতি বুঝে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতিক্রমে অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে এবং জনগণের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে আমানত হিসেবে। পরবর্তীতে সংগ্রহকৃত আমানত দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে কিনা– তা দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। দরিদ্র জনগোষ্ঠির নয়। কাজেই দুর্বল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতার দায় দারিদ্র জনগোষ্ঠির ওপর না চাপিয়ে সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের ওপর চাপানো বাঞ্চনীয়। পরস্পর দোষারোপ নয়। বরং বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দুর্বল বলে চিহ্নিত ব্যাংকগুলো কিভাবে সফল করা যায় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে কিভাবে নিরাপত্তা দেয়া যায়– সেই পথ অনুসরণ করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এমন সংকেত পাওয়া যায়, যারা দুর্বল ব্যাংকে আমানত রেখেছে তারা ভুল করেছে, তারা বেশি মুনাফার জন্য রেখেছে– তবে অর্থনীতিতে নতুন করে ধাক্কা লাগবে। অর্থনীতির ক্রম উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হবে। অন্যান্য ব্যাংকের আমানতকারীরাও শংকিত হয়ে পড়বে। আর এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ জনগণ (ধনী ও গরীব) নগদ অর্থ ব্যাংক কর্তাব্যক্তিদের জানা আছে।
এ কিছুদিন আগে খবরে প্রকাশ পেয়েছ যে, এরূপ ব্যাংক সম্পর্কিত নির্মম তথ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঘটে যাওয়ার জন্য মাত্র সাত কর্ম দিবসে ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা জনগণ উত্তোলন করে ঘরে রেখে দিয়েছে। অবশ্য এর কিছু অংশ পরবর্তীতে ব্যাংকে ফিরে এসেছে। অর্থনীতি এ অবস্থা কখনো একটি প্রসারমান অর্থনীতির জন্য কাম্য নয়। এ অবস্থার প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্বল্প কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্য যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অর্থের প্রচলন গতি (Velocity of Money) হ্রাস পাবে। এর প্রভাব পড়বে উৎপাদন ক্ষেত্রেও। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমত: কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এমন মন্তব্য করা যাবে না, যে মন্তব্যে জনগণ ভয় পায় বা অনিশ্চয়তায় ভোগে। কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ধরনের কথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে তথা ব্যাংকিং আমানতের সাথে মিশানো যাবে না। যথাযথ আইন প্রয়োগ করে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরৎ আনার ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ তথা আমানতকারী কখনো পাচারকৃত অর্থ ফেরৎ আনার ব্যবস্থা করতে পারবে না। ঋণ আকারে অর্থ প্রদান করার নিয়মের দায় দায়িত্ব যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন পাচারকৃত অর্থ ফেরৎ আনার দায় দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশ ব্যাংকের আর একটি করণীয় দায়িত্ব হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। বাণিজ্যিক ব্যাংকে আমানতকারী অর্থ গচ্ছিত রাখে বিশ্বাসের ওপর, যে বিশ্বাসের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। মেয়াদী বা সঞ্চয়ী অথবা চলতি, সব ক্ষেত্রেই আমানতকারী তার আমানতের সুরক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সাধারণত আমানতকারী যে অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে, তা তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য। কিন্তু কোনো কারণে আমানতকারী যদি মনে করেন তার মূল্যবান আমানত অরক্ষিত বা চাহিবা মাত্র ফেরৎ পাওয়া যাবে না তবে কোনো ভাবেই ব্যাংকে তিনি অর্থ রাখবেন না বরং আমানতকারী ব্যাংকে অর্থ না রেখে নিজের কাছেই রেখে দেবেন। এরূপ অবস্থাকে বলা হয় ব্যাংকের ওপর আমানতকারীদের আস্থার সংকট। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। কোনো আমানতকারী যদি দেখেন তার চেক পাস হয়নি, অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না, তখন আমানতকারীর মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়। এ ভয় অন্যান্য আমানতকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। এ আস্থাহীনতা দূর করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। যে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেক বিশেষ করে আমানতকৃত অর্থের চেক যাতে ফিরে না যায় তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে হবে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম না মেনে বাণিজ্যিক ব্যাংক অর্থ ঋণ দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। জনগণ তা পারে না। কাজেই সব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে বলে এবং ব্যাংক ব্যবসার অনুমতি দিয়েছে বলে যে কোনো সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে চালু রেখে দরিদ্র জনগণের অর্থ ফেরৎ দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। এতে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।
তৃতীয়ত: কিছু কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংককে রয়েছে তারল্য সংকট। নিকট অতীতে দেখা গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি পূরণে জাতীয় বাজেট থেকে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছিল। ব্যাংকের মালিকানা ভিন্ন হলেও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে আমানত রেখে ঝুঁকিতে পড়া আমানতকারীরা এ দেশেরই মানুষ। তাদের আমানতের নিরাপত্তায় রাষ্ট্র দায় এড়াতে পারে না। তাই অতীতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংককে যেভাবে মূলধন ঘাটতি পূরণে জাতীয় বাজেট থেকে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছিল, সেভাবে বর্তমানে মূলধন ঘাটতিতে থাকা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ সহায়তা দিয়ে এ ব্যাংকগুলোর ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা উচিত। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মনোভাব পরিহার করা প্রয়োজন। কারণ ঐসকল বাণিজ্যিক ব্যাংকে টাকা রেখেছে বিভিন্ন মতাদর্শের লোক।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতের সংস্কারে একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার এখন গঠন করেছে টাস্কফোর্স। এ টাস্কফোর্স দ্বারা ব্যাংক খাতের অবস্থার কারণ উদঘাটিত হবে না। সীমাবদ্ধতা থাকলেও এজন্য কমিশন গঠন করা উচিত।
লেখক : শিক্ষাবিদ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি, চট্টগ্রাম