বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় বিশ কোটির কাছাকাছি। আয়তনে ছোট একটি দেশে এ জনসংখ্যা বিশাল এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে এ বিপুল জনগোষ্ঠীর ৬৫% কর্মক্ষম অর্থাৎ বয়সের দিক দিয়ে তারা কাজের উপযোগী আছেন। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বি বি এস এর সর্বশেষ শ্রম শক্তি জরিপ ২০২২ এর হিসাবে বাংলাদেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮০ হাজার। বি বি এস এর হিসেব নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও আমরা তাদের পরিসংখ্যান দিয়ে আজকের আলোচনা সাজাতে চাই। আজকের প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের বেকারত্ব পরিস্থিতি এবং সার্বিক কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে চাই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিবিএস এর তথ্য মতে দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। অথচ যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাদের বেকারত্বের হার মাত্র ১. ০৭ শতাংশ। বিবিএস এর তথ্যে দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করা বেকারের হার ৮.৭৮ শতাংশ। মাধ্যমিক শেষ করা বেকারের হার ২.৪২ শতাংশ। প্রাথমিক শেষ করা বেকারের হার ১.৬৯ শতাংশ। অন্য কোন মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করা ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার ৪.৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বি আই ডি এস এর গবেষণা বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকুরী পান। সাত শতাংশ শিক্ষার্থী অন্য কোন বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে কিছু করছেন। লন্ডনের ইকোনমিক্স ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মতে বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন স্নাতকধারীর ৪৭ জন বেকার।
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবত বেশ কিছু বিষয়ে অভিযোগ ছিল এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা, বিরোধী মত দমন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যর্থতা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট, তীব্র বেকারত্ব রোধে ব্যবস্থা নিতে না পারা, নিয়োগ–বাণিজ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষ করে দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস এবং শিক্ষিত বেকারদের তীব্র হতাশা এবং সে বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে বেগবান করেছিল। এই অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে বিদ্যমান অন্যান্য নেতিবাচক অর্থনীতির সূচকগুলোর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশ থেকে বেকারত্বের তীব্রতা কমানোর জন্য জরুরী কর্মসূচি গ্রহণ করা।
কর্মসংস্থানের বৈশ্বিক গতি প্রকৃতির দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, বিশ্বের চাকরির বাজার আগের চেয়ে অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন বর্তমানের অনেক চাকরির অস্তিত্ব শীঘ্রই অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই পরিবর্তনের পেছনে প্রধান দুটি কারণের কথা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সামপ্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। তন্মধ্যে একটি হলো নতুন প্রযুক্তির উত্থান বা অটোমেশন এবং অন্যটি হলো সবুজ ও টেকসই অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মত নতুন নতুন প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি শ্রম বাজারে আমূল পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি সার্বিক অর্থনীতি উন্নয়নে সাহায্য করবে বটে তবে একদিকে যেমন অনেক কর্মসংস্থানের খাত তৈরি হবে তেমনি অনেক কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গবেষকদের মতে, আগামী পাঁচ বছরে বর্তমান চাকরির বাজার প্রায় এক চতুর্থাংশ বদলে যাবে। সুতরাং বৈশ্বিক এ পরিবর্তনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও উচিত হবে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত বেকারদের প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে সফলতা অর্জনের জন্য নতুন নতুন দক্ষতা এবং সক্ষমতা বাড়ানোর উপযোগী ট্রেনিং ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানামুখী সংস্কারের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত ও অর্থনৈতিক সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দ্রুত বেকারদের কর্মসংস্থানের নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে;
এক, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ আধা–দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকার শ্রম বাজারে চাহিদা অনুযায়ী কম খরচে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবস্থা করা।
দুই, দেশে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শিক্ষিত বেকার যুবকদের প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দিয়ে পুঁজি সহায়তা দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ করে দেওয়া।
তিন, সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান তৈরি করে পর্যায়ক্রমে দুর্নীতিমুক্তভাবে শিক্ষিত বেকারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা।
চার, শ্রমিক অসন্তোষ দূর করে নতুন নতুন রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা গড়ে তোলা। বন্ধ শিল্প কারখানা দ্রুত চালু করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
পাঁচ, বিশ্বের উন্নত দেশে বাংলাদেশের শ্রম বাজার সম্পর্কে প্রচার করার পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যত বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে তত বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে ডলার সংকট দূর করা, অর্থ পাচার বন্ধ করে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং সর্বোপরি সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করাকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা দুরূহ হয়ে উঠবে।
সার্বিকভাবে আমাদের নতুন প্রজন্ম এবং শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীকে বিশ্ববাজারে কিছু নতুন কাজের উপযোগী করে গড়ে ওঠার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অফ জবস রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে, সব ধরনের খাত এবং শিল্পে সবুজ চাকরির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। সবুজ রূপান্তরের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তিন কোটি কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। এ কর্মসংস্থান তৈরি হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অল্প শক্তি ব্যবহার করে বেশি উৎপাদন এবং কম নির্গমন প্রযুক্তি এ তিনটি খাতে। সবুজ শক্তি এবং টেকসই উন্নয়নে নতুন চাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে আপাতত যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমা দেশ এবং জাপান। এরপরে রয়েছে চীন। এ কাজগুলো ব্যবসা, বিজ্ঞান ও পরিবেশের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হতে পারে। আমাদের বেকার কর্ম শক্তিকে ঐসব কাজের উপযোগী করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ওইসব দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া আগামী বছরগুলোয় মেকানিক, মেরামতকার, ইলেকট্রিশিয়ান, নির্মাণ শ্রমিকের মত অনেক ম্যানুয়াল চাকরির চাহিদা বাড়বে। কৃষি খাতেও নতুন পেশার চাহিদা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং এ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বর্ধিত খাবারের প্রয়োজন।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি আদর্শ রাষ্ট্রে উন্নীত করতে চাচ্ছেন সেই প্রয়াসকে সফলতার মুখ দেখতে হলে দ্রুত লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে আমরা মনে করি।
লেখক : অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কায়সার নিলুফার কলেজ।
প্রধান উপদেষ্টা, রাজনীতি বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।