বাজেট শব্দটি অর্থনীতিতে ব্যবহৃত হয় অধিক। বাজেট আবার অনেক প্রকার হতে পারে। যেমন– পারিবারিক বাজেট, কোনো উৎপাদকের বাজেট, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার বাজেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাজেট, রাষ্ট্রীয় বাজেট ইত্যাদি। এখানে বাংলাদেশের বাজেট বলতে রাষ্ট্রীয় বাজেটকে বুঝানো হয়। বাজেটের সংজ্ঞায় বলা হয় যে, বাজেট হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের আয় ও ব্যয়ের খতিয়ান। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ের রাষ্ট্রের সকল প্রকার আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক হিসাবকে উক্ত সময়ের উক্ত দেশের বাজেট বলে। অধিকাংশ দেশে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকে। কাজেই রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য দৃশ্যমান পদক্ষেপগুলো সরকার গ্রহণ করে যাতে জনগণ দৃশ্যমান সুবিধা ভোগ করতে পারে। জনগণও এতে খুশি হয়। অথচ স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ একটি অদৃশ্যমান ব্যয় যা থেকে সরকার স্বল্পমেয়াদী তেমন কোন সুবিধা পাবে বলে মনে করে না। তারপরও সরকার স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করে এবং জনগণকে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে থাকে। অথচ জনগণ সরকার থেকে প্রাপ্ত স্বাস্থ্যখাতে সুবিধাসমূহকে তেমন আমলে নেয় না। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ স্বাস্থ্যখাতে প্রাপ্ত সুবিধাকে নিয়ে তেমন আলোচনা করে না। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত সুবিধাকে যে কোনো লোক কথায় কথায় উল্লেখ করে এবং প্রশান্তি ভোগ করে। যেমন– পদ্মা সেতু থেকে প্রাপ্ত সুবিধা, চট্টগ্রাম–ঢাকা রোডকে চার লেইন এ উন্নীতকরণ সুবিধা, কর্ণফুলি ট্যানেল থেকে প্রাপ্ত সুবিধা ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ থেকে জনগণ বিভিন্ন ধরণের সুবিধা পাচ্ছে কিন্তু সরকার তেমন কোনো রাজনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে না। যেমন পাচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতকরণ থেকে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকার জনগণের কল্যাণের পাশাপাশি রাজনৈতিক লাভক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখে। প্রকৃতপক্ষে জনকল্যাণ এবং রাজনৈতিকভাবে লাভবান এ দুইটি ভিন্ন বিষয়। সুন্দরবনের কাছাকাছি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সরকার জনগণের কল্যাণেই করছে। অথচ তা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়নি। স্বাস্থ্যখাতে সরকারের অধিক ব্যয় জনকল্যাণ হলেও রাজনৈতিক প্রচারণার অভাবে তা থেকে সরকার রাজনৈতিকভাবে লাভবান তেমন হচ্ছে না। অন্যদিকে রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনগণের কল্যাণ যেমন হচ্ছে তেমনি সরকার রাজনৈতিকভাবেও লাভবান হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণের সমর্থন পাওয়ার জন্য অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ বেশি করতে দেখা যায়। তাই শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মত সামাজিক খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে রক্ষণশীল আচরণ করতে দেখা যায়। এ কারণে সরকারি বরাদ্দে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রাপ্তি প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে। আবার বরাদ্দ সংশোধনের ক্ষেত্রেও একই আচরণ লক্ষ্য করা যায়। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে দেখা যায়, সংশোধিত এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) এর আকার যে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেই কমেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণের সমর্থন পাওয়ার জন্য অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করতে বেশি দেখা যায়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বিনিয়োগ থেকে সরকার যে লাভবান হতে পারে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তা সরকার বিবেচনা করে না। ফলে সরকারি কৌশলগত সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।
শিক্ষাখাতে অধিক অর্থ ব্যয় করা তা সরকার তথা জনগণের জন্য এক প্রকার বিনিয়োগ। যে কোনো দেশে শতভাগ মা কে যদি শিক্ষিত করা যায় তবে দশ বছরের মধ্যে যে কোনো দেশে শিক্ষার হার ১০০% এ উন্নীত হবে। তাছাড়া একটি দেশের মোট জনগণের প্রায় অর্ধেকাংশ থাকে নারী। এ বিশাল নারী জনগোষ্ঠিকে শিক্ষিত করে যথাযথ স্থানে নিয়োগ করলে নারী কর্মশক্তি কাজে লাগানোর ভেতর দিয়ে দেশের উন্নয়নের গতি দ্রুত হয়। জাতি হয়ে উঠে মেধাশীল। কাজেই সরকারের শিক্ষাখাতে আজকের বিনিয়োগ আগামী দিনের সমৃদ্ধি। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগও ভবিষ্যৎ মেধাশীল জাতি গঠনে সহায়ক। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে যে বিনিয়োগ হয় সে ক্ষেত্রে সরকারকে নতুন নতুন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু জনগণকে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম প্রদানের ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ হলো যে, অবকাঠামো সহজে জনগণের দৃষ্টিগোচর হয়। ফলে সরকার রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়। সরকার স্বাস্থ্যখাতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে, সেই অর্থ দিয়ে মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে সেবা তৈরি হয়। সেই সেবার মূল্য কত, তা জনগণ বুঝেন না। এমন কি কোনো ব্যক্তি তা কখনো হিসাবও করে না। যেমন সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে একজন ছাত্র এমবিবিএস পাস করার পর সে যে পরিমাণ অর্থ বেতন হিসেবে প্রদান করেছে, প্রকৃতপক্ষে তার জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে তা কখনো কোনো ছাত্র বিবেচনা করে না বা হিসাব করে না। বেসরকারি মেডিকেল থেকে পাস করা একজন ছাত্রের সাথে যদি সে তুলনা করে তবেই সেই বুঝতে পারবে সরকার তার পিছনে কত টাকা খরচ করেছে। অনুরূপভাবে সরকারি সাধারণ বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস একজন ছাত্র যদি নিজের পড়াশুনার ব্যয়ের পরিমাণকে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্রের পড়াশুনার ব্যয়ের পরিমাণের সাথে তুলনা করে তবেই সেই বুঝতে পারবে সরকার এসব ছাত্রের পিছনে কত টাকা ব্যয় করেছে। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এসব তুলনামূলক ব্যয়ের হিসাব কোনো ছাত্র করে না। এর ফলে এসব শিক্ষার্থীদের মাঝে সরকারি ব্যয়ের উপযোগিতার পরিমাপও হয় না। সরকার রাজনৈতিকভাবেও লাভবান হয় না। কিন্তু রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ থেকে সরকার সরাসরি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়।
আবার সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত কী পরিমাণ অর্থ খরচ করছে তা জানে। কিন্তু সেই অর্থ দিয়ে কি পরিমাণ মূল্যের সেবা উৎপাদন হলো সরকার তা জানে না। এটা জানা থাকলে রাষ্ট্র জনগণকে কত টাকার স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে এবং শিক্ষাখাতে কত টাকার শিক্ষাসেবা দিচ্ছে তা বলতে পারতো। এ থেকে সরকার রাজনৈতিকভাবেও অধিক লাভবান হতে পারতো। তাছাড়া বর্তমানে জনগণও জানে না তারা শিক্ষা খাত থেকে কত টাকার শিক্ষা সেবা পায় এবং সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে কত টাকার সেবা পায়। অন্যদিকে সরকারি সেবাদানকারী হাসপাতালও জানে না। রোগীকে কত টাকার সেবা প্রদান করা হয়। সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রধান অংশীদার হচ্ছে তিনটি। প্রথমত– অর্থ প্রদানকারী বা সরকার, দ্বিতীয়ত– সেবা গ্রহণকারী, তৃতীয়ত– সেবাদানকারী। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের কেউ জানে না সরকারি শিক্ষা সেবা ও স্বাস্থ্য সেবার মূল্য কত। যেমন ২০২৩–২৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এই তথ্যটি সরকার ও সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জানে। কিন্তু এই অর্থ দিয়ে সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এবং হাসপাতালে কত টাকার সেবা তৈরি হয় তা সরকার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউ জানে না। অনুরূপভাবে শিক্ষাখাতেও একই অবস্থা। আবার শিক্ষাখাতে ও স্বাস্থ্যখাতের সেবাগ্রহণকারী জনগণেরও জানা নেই তারা কত টাকার সেবা পেলেন। এ কারণে শিক্ষাখাতে ও স্বাস্থ্য খাতের সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে কারো কাছেই সরকারি শিক্ষা সেবা ও স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু জনগণ যদি জানত, তারা কি পরিমাণ শিক্ষা থেকে লাভবান হয়েছেন এবং স্বাস্থ্য সেবা খাতে তারা যে পরিমাণ টাকা ফি হিসেবে দিচ্ছে, তার বহুগুণ মূল্যের সেবা পাচ্ছে, তাহলে জনগণ সরকারি শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যখাতের গুরুত্ব বুঝতে পারত।
আবার সরকারের নিকট যদি হিসাব থাকত যে, শিক্ষাখাতে ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়িত টাকা মূল্য সংযোজিত তিনগুণ বা পাঁচ গুণ আয় বা সেবা তৈরি করছে তবে সরকার জনগণের মধ্যে তা প্রচার করে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারত। আবার বিভিন্ন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারি হাসপাতালে বিভিন্নভাবে সম্পদের যে অপচয় হয়, তা যদি হিসেবে আনা যেত, তা হলে সরকার অপচয় বন্ধ করার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারত।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষাখাত এবং স্বাস্থ্যখাত অবহেলিত। প্রকৃতপক্ষে এই দুইটি খাত থেকে জনগণ ব্যাপক উপকার পেয়ে থাকে। কিন্তু এই দুইটি খাত থেকে জনগণ কী পরিমাণ উপকার পেল তার হিসেব যেমন জনগণের নিকট নেই তেমনি সরকারের নিকটও নেই। শুধু কী পরিমাণ বরাদ্দ পাওয়া গেল তার হিসেব পাওয়া যায়। উপকার প্রাপ্তির কোনো হিসাব না থাকার কারণে এই দুইটি খাত অবহেলিত।
লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি।