বাংলাদেশের প্রথম এনাটমি মিউজিয়াম চট্টগ্রামে

রেজাউল করিম | শনিবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ

এ যেন এক কঙ্কালপুরি। চারদিকে ছড়ানো সবই বিভিন্ন প্রাণীর কঙ্কাল। এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ। এই বুঝি কামড় দিয়ে বসল হা করে থাকা সাপ এবং কুমির! অনেক উঁচু উট ও হাতির কঙ্কালটির মাথা ছোঁয়াই দায়। চারদিকে ছড়ানোছিটানো শুধু কঙ্কালই নয়, রয়েছে বিভিন্ন ছোট বড় প্রাণীর ট্যাক্সিডার্মি (মৃত পশুর চামড়ার ভিতর খড় ইত্যাদি ভরে তাকে পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর মত দেখানো), যেগুলি সত্যিকার অর্থেই জীবন্ত প্রাণী বলে মনে হয়। আরো রয়েছে কাঁচের বাক্সের ভিতরে কেমিক্যালের মাধ্যমে সংরক্ষিত বিভিন্ন রকমের প্রাণী এবং তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বিচিত্র এই প্রাণীজগতের হাজারো প্রাণের এক রোমাঞ্চকর সমন্বয় রয়েছে এই এনাটমি জাদুঘরে।

এখানে প্রায় সব প্রজাতির গৃহপালিত প্রাণীর পাশাপাশি বিভিন্ন বন্য প্রাণীর কঙ্কাল, ট্যাক্সিডার্মি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। এটি হলো চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইয়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগে গড়ে তোলা বাংলাদেশের প্রথম সুবিশাল এনাটমি মিউজিয়াম। প্রাণীদেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্রের অবস্থা, গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং কাজ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষাদান করাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি শিক্ষায় পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের তত্ত্বীয় জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য উক্ত মিউজিয়ামটি একটি অত্যাবশ্যকীয় সংযোজন। তাছাড়াও শিক্ষাবিদদের জন্য নতুন নতুন গবেষণার ক্ষেত্র তৈরিতে এই মিউজিয়ামটি অনন্য ভূমিকা রাখবে। বিশাল পরিসরে প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র এই এনাটমি মিউজিয়ামটি বিভিন্ন নিম্ন ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিনোদনের পাশাপাশি প্রাণী জগত সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি এবং ভবিষ্যতে ভেটেরিনারি পেশায় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে দেশের প্রাণী সম্পদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উচ্চশিক্ষা ও মানোন্নয়ন উপপ্রকল্পের আওতায় এনাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান এর ব্যবস্থাপনায় অত্র বিভাগের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই মিউজিয়ামটি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত মিউজিয়ামটিতে গৃহপালিত ও বন্য প্রাণীর কঙ্কাল এবং মডেলের পাশাপাশি পশুপাখি এবং তাদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্টাফিং করে রাখা আছে যা দেখলে বুঝাই যায় না যে প্রাণীগুলো আসলেই মৃত।

স্টাফিং হলো মৃতপ্রাণীর চামড়া ছাড়িয়ে ট্যানারির মতো বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পরিষ্কার করে তুলা, রড ও জিআই তার ইত্যাদি দিয়ে প্রাণীর নিজস্ব অবয়ব বহাল রাখা। প্রাচীন মিশরে প্রাণীকে তার হুবহু অবয়বে অক্ষত রাখতে মমি করা হত। যদিও মমি ও স্টাফিং এক জিনিস নয়। মধ্যযুগে জ্যোতিষী, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতারা বিভিন্ন প্রাণীর স্টাফিং করে রাখত। ১৭৪৮ সালে প্রকাশিত ফ্রান্সের রওমার অঞ্চলে প্রাকৃতিক ইতিহাসের এনসাইক্লোপিডিয়ায় স্টাফিং পদ্ধতিতে পাখি সংরক্ষণের কথা জানা যায়। ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ইংল্যান্ডে তখন এভাবে পশুপাখি, জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হত।

১৮৩৭ সালে ভিক্টোরিয়া যুগ শুরু হলে স্টাফিং জনপ্রিয় শিল্পে রূপ নেয়। তখন পশুপাখির স্টাফিং দিয়ে ব্যাপকভাবে গৃহস্থলি সাজানো হত। ১৮৫১ সালে লন্ডনের হাইড পার্কের প্রদর্শনীতে বেশ কয়েক প্রকার পাখির স্টাফিংও ছিল। তাছাড়া উক্ত মিউজিয়ামটিতে কয়েকটি প্রাণীর প্লাস্টিনেটেড অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্লাস্টিনেশান একটি জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, যাহা বাংলাদেশে এখনো ব্যাপক ভিত্তিতে পরিচিত নয়। এখানে দেশীয় পদ্ধতিতে কয়েকটি অঙ্গের প্লাস্টিনেশান করা হয়েছে।

সংরক্ষিত কংকালসমূহের মধ্যে মানুষ, হাতি, উট, কুমির, অজগর, ঘোড়া, গরু, হরিণ, ছাগল, ভেড়া, বানর, শুকর, কুকুর, বিড়াল, বাদুর, খরগোশ, গিনিপিগ, কচ্ছপ, হাঁস, মুরগী, কবুতর, কোয়েল উল্লেখযোগ্য। স্টাফিং করা প্রাণীর মধ্যে রয়েছে ছাগল, হনুমান, বিড়াল, গুইসাপ, বানর, মোরগ, রাজহংসী, কবুতর, কাঠ ঠোঁকরা, দোয়েল, পেঁচা, মাছরাঙা, কোয়েল, খরগোশ, গিনিপিগ, টিকটিকি ইত্যাদি।

মডেলগুলির মধ্যে মানব দেহ, গরু, ঘোড়া, ছাগল, শুকর, ভেড়া, কুকুর বিড়াল উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া মিউজিয়ামে মানুষ, গরু, ছাগল, শুকর ও খরগোশের ডিএনএ, ক্রোমোজোম, মগজ, চোখ, হৃৎপিন্ড, জরায়ু, ফুসফুস, কিডনি, স্তনসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মডেল সংরক্ষিত আছে। উক্ত মিউজিয়ামে বিভিন্ন গৃহপালিত পশুপাখির প্রায় সকল প্রকার অঙ্গপ্রতঙ্গ এবং বিভিন্ন বন্য প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেমিক্যালের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা আছে।

এনাটমি মিউজিয়ামের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গ এবং তন্ত্রের অংকিত চিত্র এবং জীববিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান ও এনাটমি বিষয়ে অবদান রাখা বিজ্ঞানীদের প্রতিকৃতি। উক্ত মিউজিয়ামে বিভিন্ন প্রাণীর প্রায় ৬০টি কঙ্কাল, ৩০টি স্টাফ, ফরমালিনে সংরক্ষিত বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সংখ্যা ৫০০টি, ২০০০টি বিভিন্ন হাড়, ৭৫টি বিভিন্ন প্রাণীর মডেল এবং ৩০০০টি বিভিন্ন প্রকারের স্লাইড।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাত পোহালেই ভোট
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় মরিচ ক্ষেতে বন্যহাতির তাণ্ডব