শিক্ষা হচ্ছে আচরণের স্থায়ী এবং ইতিবাচক পরিবর্তন। আর শিক্ষার একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিক্ষিত, স্বাবলম্বী, দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টি করা। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষায় যে অশনিসংকেত চলছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের ভাষা নেই। যে সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই থাকার কথা, সে সময়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে আন্দোলনে। যে কোনো বিষয়ে যখন–তখন আন্দোলনই যেন তাদের একমাত্র হাতিয়ার। পড়াশুনা, পরীক্ষার গণ্ডি শেষ না করতেই যদি শিক্ষার্থীদের হাতে লাঠি, পোস্টার, ব্যানার উঠে তবে সেসব শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারে নিমজ্জিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এভাবে তরুণ সমাজ পড়ালেখা থেকে যদি দূরে থাকে, পরীক্ষা পেছানোতেই ব্যস্ত থাকে, তবে তরুণ সমাজের মাঝে হতাশা, কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্ত হওয়ার মত অপরাধ জন্ম নেয়। আবার কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে, শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। যে শিক্ষা বাস্তবমুখী, বা হাতে কলমে শেখানো শিক্ষা নয়, তা নিয়ে শুধু পরীক্ষা পাসের মাধ্যমে সার্টিফিকেট অর্জন করে ভবিষ্যৎ বেকারই সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান চাকরির বাজারে শুধু সার্টিফিকেট নয়, বাস্তব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন যে, ডিগ্রি অর্জনের পরেও শিক্ষার্থীরা কাজের বাস্তব দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। আবার শিক্ষা মুখস্থ নির্ভর হওয়াতে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কোচিং এ দৌড়ানো একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যা শিক্ষাকে বৈষম্যমূলক করে তুলেছে। কারণ আর্থিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পক্ষান্তরে শিক্ষার্থীদের ক্লাস বিমুখ ও ক্লাস না করার মানসিকতাও দৃঢ় হচ্ছে যা শিক্ষকদের ক্লাসে মনোযোগ কমাতেও উৎসাহিত করছে। আবার বাস্তবমুখী শিক্ষার অভাব শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার একটি অন্যতম কারণ। শুধুমাত্র মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের পাঠে অমনোযোগিতা ও অনাগ্রহী করে তোলে। আবার গ্রামাঞ্চলে এমন অনেক স্কুল রয়েছে যেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অপ্রতুলতা রয়েছে, পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী নয় এবং শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ ও মানসম্মত নয়। আবার মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও মৌলিক চিন্তারও অভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ একটি বড় সমস্যা। ছাত্র রাজনীতি অনেক সময় শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়, শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অভাব দিন, দিন চরম হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ কমছে, কমছে মানবিক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন, যা ভবিষ্যতে সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে থাকছে মোবাইল ফোন। এভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহারে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনিশ্চিত জীবন থেকে রক্ষা করতে শিক্ষার গুনগত মান উন্নয়ন, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, বাস্তবমুখী ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন এবং শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি।
এ জন্য শিক্ষায় নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই একটি মানসম্মত, টেকসই ও বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। যার মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে সোনালী ভবিষ্যতের বীজ বুনন সম্ভব হবে।