বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়-আশয়

ড. আব্দুল্লাহ আল- মাসুম | মঙ্গলবার , ১১ মে, ২০২১ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ

চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। বিনোদন ও গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিনোদন উপভোগের পাশাপাশি একটি দেশ ও জাতির নিজস্ব সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্ম, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের পর থেকে ষাট এর দশক পর্যন্ত এদেশে সামাজিক ও লোকগাথা ছবিরই প্রাধান্য ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, সামাজিক অ্যাকশনধর্মী ও পোশাকি-ফ্যান্টাসিসহ বিভিন্ন ধারার ছবি বিনির্মাণ শুরু হয়। ঐসব ধারার মধ্যে সত্তর ও আশির দশকে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধকে সামনে রেখে বেশ ক’টি চলচ্চিত্র নির্মাণ ছিল উল্লেখযোগ্য। সংখ্যার বিচারে ঐ সময়ে ধর্মীয় ভাবাদর্শভিত্তিক মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি বেশি না হলেও দয়াল মুরশিদ (১৯৭৩), ঈমান (১৯৭৯), বে-দ্বীন (১৯৮০), কুদরত (১৯৮১), আল্লাহ মেহেরবান (১৯৮১), বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২), দ্বীন দুনিয়া (১৯৮৬) প্রভৃতি দর্শক মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। তবে এগুলোর মধ্যে ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ঈমান’ ছবিটি সর্বাধিক দর্শক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বাণিজ্যিকভাবেও ছিল এটি অত্যন্ত সফল ছবি। ধর্মীয় ভাবধারার একটি আদর্শ চলচ্চিত্র সমাজে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। এ বিষয়টি লক্ষ্য রেখেই ‘ঈমান’ ছবিটি নির্মিত হয়েছিল। মূলত সমকালীন ধর্মীয় মূল্যবোধের ছবিসমূহের মধ্যে ‘ঈমান’ ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এক ভিন্নমাত্রার সংযোজন। ‘ঈমান’ ছবিটির পরিচালক ছিলেন মমতাজ আলী এবং এর প্রযোজনায় ছিলেন ঢালী ব্রাদার্স। শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেছিলেন ওয়াসিম (রুস্তম ডাকাত), শাবানা (লাইলী), কবরী (ময়না- রুস্তমের ছোট বোন), রাজ (চৌধুরী- জমিদার), মোস্তফা (ইমাম)সহ অন্যান্য। ছবিটির মুক্তিপ্রাপ্তির চল্লিশ বছর পর এবং বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এর একটি পুনরালোচনা অনস্বীকার্য। ছবিটির গল্পের সংক্ষিপ্তরূপ :
সারা এলাকার মানুষ ভয়ে কাঁপে একটি নামে। সে নাম রুস্তম ডাকাত। তার নৃশংসতা, অত্যাচার, লুণ্ঠনের জ্বালায় বিনিদ্র রাত কাটায় অনেকে। কিন্তু রুস্তমের লুণ্ঠিত অর্থ সম্পদ ভোগ করে মূলত জমিদার চৌধুরী সাহেব। রুস্তম আসলে চৌধুরীরই তাঁবেদার। চৌধুরীর কথা মতো রুস্তম এক রাতে দলবল নিয়ে এক গ্রামে ডাকাতি করতে যায়। হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও আর লুণ্ঠনের শেষে ফেরার পথে সে এক বাড়ির লাইলী নামে এক মেয়ের আর্ত চিৎকারে স্তব্ধ হয়ে যায়। জ্বলন্ত আগুনের মধ্য দিয়ে রুস্তম অর্ধদগ্ধ লাইলীকে বাড়ির ভিতর থেকে রক্ষা করে নিজের আস্তানায় নিয়ে আসে। এই লাইলী তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে রুস্তমকে অনুরোধ করে ডাকাতি ছেড়ে ভালো ভাবে জীবন যাপন করতে। এক রাতে চৌধুরীর নির্দেশে অপর এক এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে রুস্তম শৈশবে হারিয়ে যাওয়া বোন ময়নাকে দেখে লুটপাটের সব মালামাল ফেলে রেখে চলে আসে। মনে পড়ে যায় তার শৈশবের স্মৃতি। রুস্তম লাইলীকে ময়নার সব কথা খুলে বলে। তারা বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীনির ছদ্মবেশে দিনের বেলায় ময়নার কাছে যায়। কিন্তু পরিচয়ের পর রুস্তম ডাকাত হয়েছে জেনে ঘৃণায় দূরে সরে যায় ময়না। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে রুস্তমের জীবনে আসে বিরাট পরিবর্তন। সে ডাকাতি ছেড়ে ভালো মানুষ হতে চায়। মাজারে গিয়ে প্রার্থনা করে এবং মসজিদের ইমামের কাছে তওবা করে পরিণত হয় একজন ঈমানদার ব্যক্তিতে। ইমামের নির্দেশে ফিরে যায় ঐ অঞ্চলের জনগণের সেবায় যারা তার দ্বারা এতদিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শোক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বালা মুছিবতে সবাই দরবেশ বাবার দোয়া চায়, পানি পড়া চায়। দেশে তখন প্রচন্ড খরা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সবাই তাকে বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলে। তখন আল্লাহর কাছে দরবেশরূপী রুস্তম এই বলে মোনাজাত করে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সে কিছু মুখে দেবে না। ততদিন রোজা রেখে যাবে। এসময়ে প্রথমে লাইলী ও পরে ময়না দরবেশের অলৌকিক ক্ষমতার কথা জেনে তার সাথে দেখা করতে আসে। লাইলী রুস্তমকে চিনতে পারে। সেও বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি নেমে আসে। কিন্তু এতোদিনের রোজাদার রুস্তমের শারীরিক অবস্থা হয়ে পড়ে সংকটাপন্ন। রুস্তম মারা যায়। রুস্তমের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে লাইলীও মারা যায়।
ছবিটির কাহিনী পর্যালোচনায় এর প্রথমাংশ অনেকটা গতানুগতিক বলে মনে হয়। কিন্তু গল্পটির দ্বিতীয়াংশটিতেই রয়েছে ছবির নামকরণের স্বার্থকতা। ছবির নায়ক রুস্তম ডাকাত নিজের অপরাধ উপলব্ধি করে সৃষ্টিকর্তার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং একজন পীরের মাজারে আশ্রয় নেয়। মাজারের খাদেম এবং ইমাম তাকে আল্লাহর নিকট নিরাশ না হয়ে নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং ‘তওবা’ করার নানা নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেন। বিশেষত ঐ খাদেম ইসলামের নিয়মানুযায়ী উপদেশ দেন যে, তুমি এতদিন যাদের ক্ষতি করেছ তাদের মাঝে ফিরে যাও। তাদের উপকার কর, সেবা কর। ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ যদি তোমাকে ক্ষমা করে তাহলেই তুমি আল্লাহর নিকট মুক্তি পাবে। নিজেকে খাঁটি ঈমানদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং খোদার সান্নিধ্য লাভের জন্য এটিই তোমার প্রধান উপায় ও পথ। ‘ঈমান’ ছবিটির মূল চিন্তা-চেতনা ও উদ্দেশ্য এ বিষয়টির সাথেই সম্পৃক্ত। যে অঞ্চলের সর্বসাধারণের নিকট রুস্তম ছিল একজন অত্যাচারী ডাকাত ও ভয়ংকর রূপী মানুষ ঈমান আনার পর সে আজ একজন শ্রেষ্ঠ সেবক ও কল্যাণকারী। অত্র এলাকার মানুষের মুক্তির জন্য খোদার নিকট প্রার্থনা করা ও সামাজিক অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই হয়ে ওঠে রুস্তমের প্রধান কর্ম। এক পর্যায়ে দেশে অনাবৃষ্টি ও খরার জন্য যখন ব্যাপক ফসল হানি, দুর্ভিক্ষ, মহামারী দেখা দেয় তখন সকলে ‘দরবেশ’ এর নিকট সাহায্য প্রার্থী হয়। তখন ‘দরবেশ’ আখ্যায়িত রুস্তমও নিজের উপর ধর্মপ্রাণ জনগণের আস্থাকে লক্ষ্য করে অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে মসজিদের ভিতর নামাজরত অবস্থায় রাতের শেষ ভাগে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হয়এবং সুদীর্ঘ মুনাজাতের মাধ্যমে খোদার সাহায্য প্রার্থনা করে। এভাবে রুস্তম নিজেকে একজন ঈমানদার সুফী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
‘ঈমান’ ছবিটির শুটিং স্পট ছিল মানিকগঞ্জ ও সাভারের ফুলবাড়ীয়া এলাকায়। শুটিংয়ের সময়ে হাজারো মানুষ দর্শক হলে তারাও ছবির অংশীভূত হয়ে ওঠে। ছবিতে দেখানো দরবেশ রুস্তমের আস্তানা ভাঙ্গা মসজিদটি এখনও ফুলবাড়ীয়ায় বর্তমান। রুস্তম হিসেবে ওয়াসিম-এর চরিত্রে সত্যিকার ‘দরবেশ’ এর প্রতিফলন ঘটে। নায়ক ওয়াসিম এর জীবনে প্রায় দেড় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করলেও ‘ঈমান’-এর চরিত্রটিই সবচেয়ে তাঁর প্রিয়। বাস্তবিক অর্থেও তিনি দীর্ঘকাল সাভার-মানিকগঞ্জ এলাকায় অনেক মানুষের নিকট ‘দরবেশ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ব্যতিক্রম ঘটনা হল, ঐ এলাকায় বেশ ক’জন সনাতন ধর্মাবলম্বী ‘ঈমান’ ছবিতে ওয়াসিম- এর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে যা বাংলাদেশের সিনেমা জগতে বিরল দৃষ্টান্ত। (ওয়াসিম সাক্ষাৎকার : বাংলাদেশ বেতার, গ্রহণে বুশরা- ুড়ঁঃঁনব.পড়স/ধিঃপয?া=১-ঢ়ডসহুঞট৮, ২২ জুলাই, ২০১৯)। এতেই ওয়াসিমের অভিনয় ও ‘ঈমান’ ছবির বাস্তব স্বার্থকতার পরিচয় খুঁেজ পাওয়া যায়। তাছাড়া এ ছবিতে ওয়াসিম প্রথমে ডাকাত সর্দার পরে তাঁর বোনের খুঁজে বৈষ্ণব রূপ ধারণ এবং সবশেষে জনসাধারণের নিকট একজন প্রকৃত দরবেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ- এভাবে একই ছবিতে তিনটি চরিত্রে অভিনয় করে সিনেমা শিল্পে এক অনন্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তাঁর মতে পরে কোন এক অজানা কারণে তাঁর নামটি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় এবং সে বছরে কাউকেই ঐ পুরস্কার দেয়া হয় নি। (ওয়াসিম সাক্ষাৎকার : গ্রহণে লেখক, ঢাকা: ২৩ অক্টোবর ২০১৯, আরও দেখুন ুড়ঁঃঁনব.পড়স/ধিঃপয?া=১-ঢ়ডসহুঞট৮, ২২ জুলাই, ২০১৯)। ‘লাইলী’ চরিত্রে শাবানা ও ‘ময়না’ চরিত্রে কবরীর অভিনয়ও ছিল মনোমুগ্ধকর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ঐ দুই প্রধান নায়িকাকে যে দু’একটি ছবিতে একসাথে অভিনয় করতে দেখা যায় ‘ঈমান’ তার অন্যতম। এক্ষেত্রে পরিচালক মমতাজ আলী কৃতিত্বের দাবিদার। তাছাড়াও পরিচালক মমতাজ আলী ১৯৭৯ সালের অনাবৃষ্টির পরিবেশে ছবির শুটিং করে তৎকালীন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাসকেই বাস্তবে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ছবিটিতে ধর্মীয় বিষয়ের উপস্থাপনায় কোন প্রতারণা বা ভণ্ডামির আশ্রয় নেয়া হয় নি। ছবির শেষাংশে দরবেশ রুস্তমের উক্তিতে ‘বৃষ্টি আসবেই… আল্লাহ তাঁর বান্দাহকে নিরাশ করেন না’ -অত:পর বৃষ্টির আগমনের ঘটনাটি কখনোই তথাকথিত অলৌকিকত্ব বা কুসংস্কার নয়, বরং আল্লাহর নিকট এক প্রিয় গোলামের দীর্ঘ একান্ত আবেদন-নিবেদনের ফসল। তবে ছবির কাহিনীর এক পর্যায়ে রুস্তম ডাকাত নিজের মুক্তির জন্য প্রথমে এক পীরের মাজারে সেজদাহ প্রদান করে। কিন্তু বিষয়টি ইসলাম স্বীকৃত নয়। এটি উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে অজ্ঞানতাবশত একটি প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার। হয়ত পরিচালক সেই কুসংস্কারের চিত্রকেই তুলে ধরেছেন। তবে দরবেশরূপী রুস্তম তার পরবর্তী জীবনের পুরোটাই মসজিদকেন্দ্রিক জীবন অতিবাহিত করে। তাকে আর কোন কুসংস্কারের চিন্তা বা আশ্রয়ে দেখা যায় নি। এভাবে সার্বিক বিচারে ছবিটিতে অনেকটা ইসলামের সুফী ভাবধারার প্রকাশ পেয়েছে। দেশের সাম্প্রতিক সামাজিক অস্থিরতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে মানুষের মাঝে পারষ্পরিক সম্প্রীতি, সদ্ভাব ও সাম্যনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘ঈমানের’ ন্যায় আরো ছবি তৈরী হোক এটি সুস্থ রুচিসম্পন্ন দর্শকদের প্রত্যাশা।
পুনশ্চ : ‘ঈমান’ ছবির নায়ক ওয়াসিম এবং অভিনেত্রী কবরী আজ আমাদের মাঝে বর্তমান নেই। তাঁরা যথাক্রমে গত ১৬ এপ্রিল ও ১৭ এপ্রিল, ২০২১ ইহজগত ত্যাগ করেন। নায়ক ওয়াসিম ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ বডি বিল্ডার ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি এবং ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি মি. ঢাকা এবং ১৯৬৯ সালে মি. ইস্ট পাকিস্তান খেতাব লাভ করেন। মহান আল্লাহ ওয়াসিম এবং কবরী উভয়কেই জান্নাত দান করুন, আমাদের সেই দোয়া-ই রইল।
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনাময় ঈদ
পরবর্তী নিবন্ধপবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন : সময়ের প্রেসক্রিপশন