বাংলাদেশের ঘরে ফেরা

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি | সোমবার , ১০ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

টুঙ্গিপাড়া থেকে প্রখ্যাত শেখ পরিবারের খোকা, খেলার সাথীদের মিয়াভাই, বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে বাঙালি জাতিসত্তার জনক শেখ মুজিবুর রহমান, অতঃপর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালি, বাংলা, বাংলাদেশ-সবকিছু ছাপিয়ে মুজিব সমগ্র বাংলাদেশ।
ঘরে ফেরার দিনে তাঁকে গভীর ভাবে মনে করি, শ্রদ্ধা জানাই। ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর অসম্পৃক্তি উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা। যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’। গভীর এই মমতা ও বাঙালি বোধের চিরন্তন বাণী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের।
২৮৯ দিন পাকিস্তানের কারাগারে আটক থেকে বাঙালির নয়নমণি শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন হয়ে দেশে ফিরেন। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধ হয়েছিল ২৬৬ দিন। তার মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ ছিল ১৩ দিন। ১৯৭১ খ্রি. ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। আরও ২৩ দিন পর বিভিন্ন নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে বাঙালির নেতা, নিপীড়িত মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরাজিত পাকিস্তান থেকে মুক্তি লাভ করেন।
লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেলে বসে তিনি স্ত্রী সস্তানদের সাথে দীর্ঘ দিন পর ফোনে কথা বলেন। কথা বলেন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী গুরুত্বপূর্ণ দেশ ছিল আমাদের প্রতিবেশী ভুটান ও ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কেন্দ্র যুক্তরাজ্যের বিপরীতমুখী অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট। যুক্তরাজ্যের সরকার ও জনগণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা দান করেছে।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের বিভিন্ন অধিবেশনে ভোটদানে বিরত থাকলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতি তাদের ছিল নীরব, কখনও কখনও সরব দৃঢ় সমর্থন।
কিন্তু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে তাদের ভিতর দ্বিধা ছিল, দ্বন্দ্ব ছিল।
দীর্ঘ নয় মাস তখনকার চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মুসলিম বিশ্বের কতিপয় দেশের প্ররোচনা, অপপ্রচার ছিল এই যে, সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি কম্যুনিস্ট প্রভাবিত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অপপ্রচারণা। এই মর্মে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং তাদের মিত্ররা এমনতর প্রচারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। কিছুটা বিভ্রান্তও ছিল।
বাস্তবতা ভিন্ন হলেও কূটনৈতিক কূটকৌশল প্রয়োগ করে বাংলাদেশের জন্মকে আঁতুড় ঘরে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এটি ছিল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার এবং অপচেষ্টা।
৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের চেতনা ও চর্চার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে নিঙন-কিসিঞ্জার সরকার ভারতের উপর প্রতিশোধ নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে এন্টারপ্রাইজ নামের সপ্তনৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের কাছে নিয়ে এসেছিল। অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকিও দিয়েছিল।
উল্ল্যেখযোগ্য বিষয় হলো- চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র ও সর্বপ্রকার সহযোগিতা দিলেও যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হওয়া থেকে আগেই কূটনৈতিক ঘোষণা দিয়ে বিরত ছিল।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বিশ্ব সমপ্রদায়ের কতিপয় দেশের ভাবনা ছিল, ভারত বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের বিলম্ব করতে পারে। এটি সুদূর প্রসারী হতে পারে। বাংলাদেশ পরিপূর্ণ স্বাধীনতার সুফল ভোগ নাও করতে পারে। যেটি জাপান, কোরিয়া , কুয়েত ও জার্মানির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করেছিল। বিষয়টি সদ্য পাকিস্তানের কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনাকে এড়িয়ে যায় নি।
তিনি ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ খ্রি. ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে এই বিষয়ে ইঙ্গিত পেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
বাঙালি জাতিসত্তা ও ভূখণ্ডগত মুক্তির মহান এই নেতাকে দেখে লন্ডনের ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ৮ জানুয়ারি বিকালে গাড়ির দরজা খুলে করমর্দন করে স্বাগত জানিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেন,
‘শেখ মুজিবুর রহমান একজন রাষ্ট্র প্রধানই নন, তিনি একটি মহান জাতির শ্রষ্টা এবং বর্তমান বিশ্বের একজন বিরল জনপ্রিয় বিপ্লবী নেতা। তাঁকে সম্মানিত করে আমরা আমাদেরকে ধন্য মনে করেছি, সম্মানিত মনে করেছি, মহিমান্বিত মনে করেছি।’
লন্ডন থেকে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আসার পথে পাকিস্তান কিংবা মুসলিম দেশসমূহের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আশ্রয় নিতে পারে। এমন বিবেচনায় এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ ও মুজিবের প্রতি অনুভূতির গভীরতা পর্যালোচনায় ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানের একটিকে বাঙালির জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বহন করে দেশে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
ইন্দিরা গান্ধী এ ক্ষেত্রে একই সাথে দুইটি কূটনীতিকে বাস্তবায়ন করেন। যুক্তরাজ্যের সহযোগিতার মধ্য দিয়ে তাদের স্বীকৃতির আভাস এবং নিরাপদে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশে আসার সুযোগ করে দেয়া।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সারা দুনিয়ার দেশসমূহের ভিতর ভারত সোভিয়েত রাশিয়ার মিত্র ছাড়াও অন্যান্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য তখন অপরিহার্য ছিল। যার ক্ষেত্রে অপ্রকাশিত বাধা ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার।
বাংলাদেশের পথে মুজিবের দীর্ঘপথের সহযাত্রী হয়েছিলেন ভারতের তখনকার লন্ডন কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী।
মুজিব তাকে বলেন মিসেস গান্ধীর কাছে বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য সরিয়ে নেয়ার নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার অনুরোধের কথা।
শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী বিচলিত বোধ করলেও দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন পরীক্ষিত।
দিল্লির পালাম বিমানবন্দর (ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর) এ ১০ জানুয়ারির ভোরে, শীতের কোমল রোদে ব্রিটিশ বিমান অবতরণ করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ স্বাগত জানান। মুজিবের প্রস্তাবনা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
সংক্ষিপ্ত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মুজিবকে কলকাতার গুড়ের সন্দেশ, দার্জিলিঙের চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সৈন্য ফিরিয়ে আনার তারিখ, ক্ষণ ঘোষিত হয়। মুক্ত মুজিব সফল কূটনীতির প্রথম অঙ্ক সমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন তাঁর জনতার মাঝে। পথে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বিখ্যাত গান গুন গুন করে পরিবেশন করেন।
বাঙালি জাতিসত্তার মুক্তির মহান নেতা এভাবেই দেশের মাটিতে পা রেখে মুক্ত মানুষদের দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে তাঁর দিক নির্দেশনাপূর্ণ ভাষণ পরিবেশন করেন। ৬ দফা এবং ১১ দফার শর্তের আলোকে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
উত্তাল তরঙ্গরক্তে কেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুখবিলাস বিজয় ৫০ তম বর্ষ অতিক্রম করেছে। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত জীবন দিয়ে, চেতনার স্বপ্নবুনে এ দেশকে উন্মুক্ত করে গেছেন।
বাংলাদেশের জন্য তাঁর দেহের শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিয়ে সর্বকালের সেরা বাঙালিতে অভিসিক্ত হয়েছেন। অনন্ত কালের জন্য বাংলাদেশের জল, মাটি, আলো বাতাসের সাথে মিশে আছেন। মিশে আছেন চেতনায়, মননে, রণনে।
বাঙালি জাতিসত্তা থেকে শুরু করে পৃথিবীর মানুষ এই মহান নেতাকে কোনোভাবেই কোনোকালেই বিস্তৃত হতে পারবে না।
পৃথিবীতে মানুষ জন্মের পর থেকে নেতা আসে, নেতা যায় কিন্তু ইতিহাস বিনির্মাণের নেতা হাজার বছরের খুব কম জন্ম নেয়।
বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মানবতার নেতৃত্বের সংবেদনশীলতার সব মহিমান্বিত অর্জনকে অঙ্গে ধারণ করে এমন উচ্চতায় উঠে আছেন যে, বাঙালি জাতিসত্তা তার অস্তিত্ব টিকে থাকা পর্যন্ত মাথা উঁচু করে শুধু তা দেখবে এবং অহংকারে আপ্লুত হবে।
যদি না থাকে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ তবুও কীর্তি রইবে তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
তাঁর দেশে ফেরার ৫০ তম বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে।
লেখক: অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রামের প্রধান সমন্বয়ক, মুক্তিযোদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নতুন দেশ গড়ার প্রেরণা
পরবর্তী নিবন্ধমহান পুরুষোত্তমের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্ণতা