সংকট বিহীন অর্থনীতি বিশ্বে দেখা যায় না। বিশ্বের যে সব দেশসমূহকে আমরা উন্নত দেশ হিসেবে মনে করি সেই সব দেশেও সংকট রয়েছে। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়। আমাদের মত দরিদ্র অর্থনীতিগুলো অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে ভুগছে। আর উন্নত দেশগুলো কর্তৃত্ব বজায় রাখার সংকটে ভুগছে। অতএব বলা যায়, অর্থনীতির সংকট বিশ্বব্যাপীই। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন বার্তা সংস্থা ‘সিএনবিসি ওয়াল স্ট্রিটের’ ৪০০ প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা, সম্পদ বিশ্লেষক ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপকের মধ্যে একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল। উক্ত জরিপ পরিচালনা করার পর ব্যাপকভাবে তথ্য উপাত্তকে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্থনীতিতে পাঁচটি সংকট রয়েছে যা অর্থনীতি ক্রম উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পাঁচটি সংকট হয়– ১. মূল্যস্ফীতির চাপ, ২. মানুষে মানুষে বৈষম্যের ক্রম বৃদ্ধি, ৩. শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া, ৪. অমিক্রন (এক প্রকার ভাইরাস যা করোনার মত) এর আঘাত ক্রমাগত বৃদ্ধি, ৫. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ক্রমাগত সুদের হারকে যদি বৃদ্ধি করা হয় তবে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বব্যাপী। আর এর কারণে বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম বৃদ্ধি পাবে।
এসব সংকট উত্তরণের জন্য করোনা পরবর্তী বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০২২ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে বিশ্বের অর্থনীতিতে ক্রমাগত উন্নয়নের একটি সুবাতাস প্রবাহিত হতে দেখা যায়। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়ে যায় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। পৃথিবী নামক গ্রহে যতগুলো দেশ আছে– উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল, স্বল্প উন্নত, দরিদ্র–প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে এ যুদ্ধ দিয়েছে বৃহৎ ধাক্কা। প্রতিটি দেশের উন্নয়নের গতিধারাকে করেছে প্রভাবিত। আবার এ যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো নিজ নিজ বলয় থেকে সমর্থন করেছে ইউক্রেনকে। আর্থিক সাহায্য, সামরিক সাহায্য এবং এখনো পর্যন্ত দিয়ে চলছে মানসিক সাহায্য। এর বিপরীতে রাশিয়া একাই সবকিছু মোকাবেলা করছে। এ যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। বিশেষ করে রাশিয়া তেল ও গ্যাস রপ্তানি করে পশ্চিমা বিশ্বে। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো একজোট হয়ে রাশিয়ার তেল রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য রাশিয়ায় মালিকানাধীন তৈলবাহী জাহাজগুলোর ওপর বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে। ফলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো তুলনামূলক কম দামে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে পারেনি। এমন কি এখনও পারছে না। তবে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে রাশিয়া থেকে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্যাস রপ্তানি এখনও বলবৎ আছে। পশ্চিমা বিশ্বের এরূপ নির্লজ্জ দ্বৈতনীতির কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো, বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। অথবা এসব দেশের উন্নয়নের গতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া–ইউক্রেন এর মধ্যে যে দীর্ঘমেয়াদী একটি যুদ্ধ বাধবে তা কেউ ধারণা করতে পারেনি। আর এ যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যে এরূপ ওলটপালট হয়ে যাবে তা ছিল অর্থনীতিবিদদের ধারণার বাইরে। কোভিড–১৯ দুর্বল হয়ে আসার পর বিশ্ব অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারের পথে, তখনই এ যুদ্ধ ছিল বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত। এ আঘাতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও হয়েছে ক্ষতি–বিক্ষত। ২০২২ সালের শুরু থেকে ২০২৪ সালের শেষের দিকে এসে বাংলাদেশের অর্থনীতি তেমন ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অবশ্য বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে না পারায় অনেকগুলো কারণের মধ্যে বিগত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ঘুষ, দুর্নীতি এবং সর্বপরি চাঁদাবাজিও কম দায়ী নয়। এ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নতুন সরকার অর্থনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে গেলে বেশকিছু সংকটের সম্মুখীন হবে। এই সংকটগুলো দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করতে হবে। নতুন সরকারকে প্রথমে যে সংকট মোকাবেলা করতে হবে তা হলো খাদ্য সংকট। ছোট্ট একটি দেশে প্রকৃত জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৮ কোটি। এ ১৮ কোটি মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেয়া বা খাদ্যের নিশ্চয়তা দেয়া নতুন সরকারের প্রধান দায়িত্ব। একদিকে বিশ্বের খাদ্য ভাণ্ডার বলে বিবেচিত ইউক্রেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য রপ্তানি করতে পারছে না। কিছু কিছু দেশের মধ্যস্ততায় ইউক্রেন থেকে কিছু খাদ্য রপ্তানি করলেও বর্তমানে তা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া হঠাৎ করে ভারত থেকে আসা বিশাল জলরাশি এদেশের কুমিল্লা, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, ফেনী জেলাগুলোকে বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এসব অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। সরকারের কৃষি বিভাগের উচিত, বন্যার পানি শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কৃষকদেরকে দ্রুতগতিতে বীজ সহায়তা দিয়ে উৎপাদনে উৎসাহিত করা। অন্য যে কোন পণ্যের ঘাটতি মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে ধীরগতিতে। কিন্তু খাদ্য ঘাটতির প্রভাব পড়ে দ্রুত গতিতে।
পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সংকট দেখা দেবে তা হলো রিজার্ভ সংকট। ২০২০ সালের নভেম্বর করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার কোটি ডলার। নতুন সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য পরবর্তী দুই মাসের ব্যবধানে তা ২৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের মত একটি অনুন্নত দেশে (উন্নয়নশীল এখনও হয়নি) ২৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকা ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ বিদেশী ঋণের সুদ, খাদ্য আমদানি এবং প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে হঠাৎ করে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার যদি চলে যায় তবে অর্থনীতি ঝুঁকিতে চলে যাবে। কাজেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য পোশাক শিল্পের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি যেমন বাড়াতে হবে তেমনি হুন্ডির দাপট হ্রাস করে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করার দিকে জোড় দিতে হবে।
কর প্রবৃদ্ধির পরিমাণ বাংলাদেশে খুবই কম। কর–জিডিপি অনুপাত এখন বাংলাদেশে ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অথচ নেপালে এ অনুপাত ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। লাওস নামক একটি ছোট দেশে এই হার ১৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। কর জিডিপি এর অনুপাতকে অবশ্য বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় বৈষম্য যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি সরকারি আয় সংকুচিত হয়ে যাবে। বাধাপ্রাপ্ত হবে এ দেশের উন্নয়ন।
নতুন সরকারকে ভাবিয়ে তুলবে এ দেশের দুর্বল ব্যাংকিং খাত। বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংকিং খাত ক্রমাগত দুর্বল হলেও এ খাতকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে শুধু অর্থনীতির স্বার্থে। কারণ ব্যাংকের সাথে জড়িয়ে আছে এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠি এবং অর্থনীতির প্রাণ–ব্যবসায়ী সমাজ। সে কারণে ব্যাংকিং খাতকে শক্ত হাতে পরিচালনা করার প্রয়োজন ছিল। যদি বিচার ও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাত থেকে বের হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে বিনিয়োগ হয়েছে অথবা দেশে জামানতকৃত সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের লোন ফিরিয়ে আনা যাবে তবে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্যাংক খাতকে অর্থনীতিমুখী করে পরিচালনা করতে হবে। কোন অনিশ্চিয়তা দেখিয়ে নয়। অন্যথায় ভবিষ্যতে অর্থনীতি গভীর খাদে পড়ে যাবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আর একটি সম্ভাব্য সংকট দেখা দিতে পারে তা হলো আমদানি নির্ভর জ্বালানি খাত। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশে প্রাপ্ত গ্যাসও দিন দিন কমে আসছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে পূর্ববর্তী সরকার এল এন জি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করা শুরু করে। নিজ দেশের গ্যাস ও এলএনজি দিয়ে শিল্পের গ্যাসের চাহিদা ও আবাসিক গ্যাসের চাহিদা পূরণ করে আসছিল। তবে এলএনজি আমদানিতে সরকারকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। আবার কোনো কোনো সময় যথাসময়ে এলএনজি এসে পৌঁছায় না। ফলে শিল্পে গ্যাসের জোগান দেয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয়। পোশাক শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হলে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় সম্ভাবনা থাকে। কাজেই সরকারকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, ইউএসটিসি, চট্টগ্রাম