পরিবর্তনশীল বিশ্বে সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছয় বছর আগে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) স্থির করার পর যে তিনটি দেশ তাদের আগের অবস্থান থেকে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করতে পেরেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক সোমবার ২০২১ সালের যে অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতেই উঠে এসেছে এ চিত্র। গত ১৬ জুন দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, এবারের এসডিজি সূচকে বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। চার বছর আগে ২০১৭ সালের সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে জাতিসংঘে গৃহীত এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে পূরণের জন্য মোট ১৭টি লক্ষ্য স্থির করা হয়। সেসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর অগ্রগতি বিচার করেই এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৫৭টির তথ্য এবারের প্রতিবেদনে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের পর থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোই এসব লক্ষ্য পূরণের পথে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে। আর ২০১৫ সালের পর থেকে এসডিজি সূচকে স্কোরের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ, কোত দি ভোয়া (আইভরি কোস্ট) এবং আফগানিস্তান।
করোনায় ঝুঁকিতে পড়েছিল টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন।এজন্য কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে পাঁচটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। বিষয়গুলো হলো- শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য ও উন্নয়ন, ক্লিন এনার্জি, টেকসই ভূমি এবং ডিজিটাল টেকনোলজির ব্যবহার। তবে এর মধ্যেও এসডিজি বাস্তবায়ন সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে সঠিক পথেই রয়েছে। তাঁরা বলেন, দারিদ্র নিরসনে বাংলাদেশ সঠিকভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। তবে অতিদারিদ্র্য নিরসনে ভালো করলেও সাধারণ দারিদ্র্য নিরসন হার কমেছে। এছাড়া কোভিড-১৯’র নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। এ অবস্থায় পারস্পারিক অংশীদারত্ব এবং সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্ব বৃদ্ধিতে জোর দিতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এসডিজি বাস্তবায়ন বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সমস্ত কর্মকাণ্ড এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি, সুশীল সমাজ এবং দেশের সকল শ্রেণিকে সঙ্গে নিয়েই এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব। এসডিজির জন্য বাজেট বরাদ্দ নেই। এক্ষেত্রে জেলা পর্যায় বাজেট থাকা প্রয়োজন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সূচকে আমরা এগিয়েছি। অবস্থান ভাল হয়েছে। এই সূচক পরিমাপের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সময় লেগেছে। এসডিজির সব গোল নিয়েই কাজ হচ্ছে। ১৫৯টি লক্ষ্য সবগুলো মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যগুলো সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও এটি অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়গুলো যেসব উন্নয়ন কার্যক্রম নিচ্ছে সবগুলোই এসডিজির লক্ষ্যের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোভিড মোকাবিলায় সকলে কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী করোনার শুরুতেই প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। সব শ্রেণির শিল্পের জন্যই এই প্যাকেজ রয়েছে। তাছাড়া গরিব মানুষদের নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। দরিদ্র্য মানুষদের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে।
স্বাস্থ্য সঙ্কটের পরেও বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নে সর্বোত্তম প্রচেষ্টার প্রশংসা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, জিডিপির ৪.৩৪% অর্থাৎ ১৪.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার মহিলা, হতদরিদ্র, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম জোরদার করেছে। শিক্ষাখাতের সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের ব্যাপকভিত্তিক দূরশিক্ষণ কার্যক্রমসহ নানা ডিজিটাল কর্মসূচির কথাও উল্লেখ করেন তাঁরা।
জাতিসংঘে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য গৃহীত হওয়ার পর থেকে সামগ্রিকভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমোন্নয়নের ধারায় থাকলেও মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালে প্রথমবারের মত তাতে ছেদ পড়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারী কেবল স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেনি, টেকসই উন্নয়নেও সংকট তৈরি করেছে। এসডিজির যে ছয়টি মূল লক্ষ্য, সেগুলোতে জোর দিয়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের আর্থিক পরিকল্পনা সাজাতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা করোনা পরিস্থিতে প্রয়োজনে বাজেট পুনর্বিন্যাস করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সরকারের কমিটমেন্ট আছে, সেখানে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গণমানুষের উন্নয়নে কাজ করে যেতে হবে।