বাঁশের ব্যবসায় কমছে লাভ

রাঙামাটিতে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা, শুল্কহারও দ্বিগুণ

প্রান্ত রনি, রাঙামাটি | বুধবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

একসময় রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে ওঠা কর্ণফুলী পেপার মিলসে (কেপিএম) পাহাড়ের উৎপাদিত বাঁশ দিয়ে তৈরি হতো কাগজ। পাহাড়ি বাঁশ দিয়ে রূপান্তরিত সেই কাগজ ছড়িয়ে যেত দেশের বিভিন্ন সরকারিবেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

কেপিএমের কাগজের সেই জৌলুস আর নেই। কর্ণফুলী কাগজকলে এখন বাঁশ দিয়ে কাগজ তৈরি হচ্ছে না। বেসরকারি শিল্প গ্রুপের বাজার নিয়ন্ত্রণে কমেছে কেপিএমের কাগজের কদরও। তবে স্থানীয়ভাবে পাহাড়ের বাঁশের কারবার এখনো চলছে। কেপিএমমুখী ব্যবসা না থাকলেও চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজঙ্গলে উৎপাদিত বাঁশ বাজারজাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সম্প্রতি রাঙামাটি সদর উপজেলা কুতুকছড়ি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, খালের মধ্যে পানিতে ভাসিয়ে শ্রমিকরা বাঁশের চালা আনছেন। শ্রমিকদের কেউ কেউ সেই বাঁশ বেঁধে প্রক্রিয়াজাত করছেন। আবার কেউ কেউ বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে কাঁধে করে এনে ট্রাক ভর্তি করছেন। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির কাউখালী, কাপ্তাই, নানিয়ারচর উপজেলা ও জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশ বাজারজাতকরণ করা হয়।

এদিকে বাঁশ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় উৎপাদিত বাঁশের চাহিদা থাকলেও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে বন বিভাগ আগের চেয়ে বাঁশে শুল্কহার বাড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বাঁশের কারবারে খরচ বাড়ায় স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে বাজারমূল্য অনুযায়ী অনেকটা কম দামেই বাঁশ কিনতে হচ্ছে তাদের। এতে করে কমছে বাঁশের বাজারজাতও। বর্তমানে পাহাড়ে উৎপাদিত এসব বাঁশ ফরিদপুর, ঢাকার সাভার, সরাইল, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ভৈরব, নোয়াখালী, টেকনাফ, শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাজারজাত করা হচ্ছে। চলতি ২০২৪২৫ অর্থবছর থেকে শুল্কহার বাড়ার কারণে বেড়েছে পরিবহন খরচসহ সংশ্লিষ্ট খাতের খরচ। এতে করে বাঁশ ব্যবসায় লাভ কমে আসছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

বন বিভাগ রাঙামাটি অঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি সদর, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল, নাড়াইছড়ি, মাচালং, পশ্চিম লক্ষীছড়ি, পূর্ব লক্ষীছড়ি, বাঘাইহাট, শিজক পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি, রেংকার্য্য, ছোট মেরুং, বড় মেরুং, কবাখালী, তারাবুনিয়াা, ঘাগড়া, কাঁশখালী, ঘিলাছড়ি, মুবাছড়ি, কলমপতি, না ভাঙা, উল্টাছড়ি, লংগদু, ইয়ারিংছড়ি, মাইনিমুখ, সাপছড়ি, মানিকছড়ি, হেমন্ত মোন, বসন্ত মোন, কাইন্দ্যা, ফুলগাজী, বাপেরছড়া, কুতুবদিয়া, ভার্য্যতলী, বারদপোলা, সাক্রাছড়ি, বহালতলী, ঘিলাছড়ি, ছোট মহাপুরমপুর, হাজাছড়ি, বুড়িঘাট, তৈ চাকমা, ক্যাঙ্গালছড়ি, লেমুছড়ি, চৌংড়াছড়ি, থলিপাড়া, নুনছড়ি, বানরকাটা, ছোট ধুরুং, জারুলছড়ি, দুল্যাতলী, ময়ূরখীল, দেবালছড়ি, গোইনছড়ি, রাঙাপানি, রাজবিলা, রাইখালী, রাজস্থলী, ধনুছড়ি, খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, রামগড়, মানিকছড়ি এলাকায় বাঁশ উৎপাদন, আহরণ ও বাজারজাতকরণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বাজালি, ছোটিয়া, মুলি, টেংরা মুলি, ওরাহ, মিতিঙ্গা, ডলু, নলি, বাড়িওয়ালা, ছাতারবাটা ও কালিছড়ি জাতের বাঁশ উৎপাদন হচ্ছে।

রাঙামাটির কুতুকছড়ি এলাকার স্থানীয় পাইকারি বাঁশ ব্যবসায়ী আব্দুল হক জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাঙামাটির বাঁশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমরা চাহিদা অনুযায়ী বাঁশ দিতে পারছি না। আগে যে প্রজাতির বাঁশে ২ টাকা করে শুল্কহার দিতাম এখন সেটা ৪ টাকা করা হয়েছে। আবার কিছু বাঁশে ৭ টাকার বদলে ১৪ টাকা করে শুল্কহার নিচ্ছে বন বিভাগ। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমরা আগের চেয়ে বেশি দাম নিতে পারছি না। আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পথে পথে চাঁদাবাজি কমলেও এখন আগের চেয়ে বেড়েছে। আগে শেরপুর যেতে আমাদের ১ লাখ টাকার মতো পরিবহনসহ খরট হতো। এখন সেটা ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো লাগছে। আমরা তাই স্থানীয়দের কাছ থেকে বাঁশ ক্রয় কিছুটা কমিয়ে দিয়েছি। আবার বাজার অনুযায়ী ন্যায্য দাম না পাওয়ায় প্রান্তিক চাষিরাও বাঁশবাগান ছেড়ে অন্যান্য বাগান গড়ে তুলছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও উপবন সংরক্ষক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, সারা দেশেই পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় উৎপাদিত বিভিন্ন বাঁশের চাহিদা রয়েছে। এখন তো কঙবাজারের টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রচুর বাঁশ যায় রাঙামাটি থেকে। বাঁশ ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা আপাতত কোনো ত্রুটিজটিলতা দেখছি না। তবে শুল্কহার যেটা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে সেটা অনেক আগের শুল্কহার। সেজন্য এটা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে, দেশের জন্যও তো কিছু রাজস্ব দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে এলো ৫২ হাজার টন সয়াবিন তেল
পরবর্তী নিবন্ধমোমেনের নেতৃত্বে নতুন দুদক কমিশন