অপূর্ব কারুকাজের একেকটি দৃষ্টিনন্দন কল্পজাহাজ কয়েকটি নৌকায় একত্রে বসিয়ে ভাসানো হয় নদীতে। শত শত প্রাণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে কল্পজাহাজগুলো ঘুরে বেড়ায় নদীর এপার থেকে ওপারে। বৌদ্ধ নারী–পুরুষসহ উৎসবে–আনন্দে মেতেছে নদীর দুই পাড়ের সকল ধর্মের মানুষ। এ উৎসব হাজারো দর্শনার্থীর অংশগ্রহণে সম্প্রীতির সম্মিলনে পরিণত হয়। বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে যুগ যুগ ধরে রামুর বাঁকখালী নদীতে কল্পজাহাজ ভাসানোর উৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এই জাহাজ ভাসা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, কোনো দুষ্টচক্র যাতে আমাদের ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি নষ্ট করতে না পারে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যের যে ঐতিহ্য রয়েছে, এটাকে আমরা লালন করি। আগামীতেও এটা আমরা লালন করতে থাকব। আমরা সবাই মিলে এ দেশকে শান্তির নিবাস হিসেবে গড়ে তুলি। তিনি বলেন, সম্প্রীতিতেই শান্তি। যে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই, সেই দেশের উন্নতি হতে পারে না। দেশের স্থিতিশীলতা আসে না। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও উৎপাদন হতে পারে না। দেশের উন্নয়নের জন্য সম্প্রীতি অপরিহার্য।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত হয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কল্পজাহাজ ভাসানো উৎসব। এবার ভাসানো হয় সাতটি কল্পজাহাজ। গান–বাজনা, কীর্তন ও ফানুস ওড়াউড়িতে মেতে উঠেছে বিভিন্ন বয়সের নারী–পুরুষ। বাঁশ, কাঠ, বেত ও রঙিন কাগজে বিহার, হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, হাঁস, ড্রাগনসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এসব কল্পজাহাজে। চমৎকার নির্মাণ শৈলী আর বৈচিত্র্যে ভরা প্রতিটি জাহাজই যেন নিজস্ব স্বকীয়তার ভরপুর। ভাসমান এসব কল্পজাহাজে চলছে বৌদ্ধ কীর্তন। কেউ নাচছে, কেউ গাইছে, আবার কেউ ঢোল, কাঁসাসহ নানা বাদ্য বাজাচ্ছে।
‘সম্প্রীতির জাহাজে, ফানুসের আলোয় দূর হোক সাম্প্রদায়িক অন্ধকার’ স্লোগানে রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাহাজ ভাসানো উৎসব। এ উৎসবে রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের হাজারীকুল, উত্তর শ্রীকুল, দ্বীপ শ্রীকুল, মধ্যম মেরংলোয়া বড়ুয়া পাড়া, পূর্ব মেরংলোয়া, হাইটুপি বৌদ্ধ গ্রাম থেকে এবং রাজারকুল ইউনিয়নের পূর্ব রাজারকুল বড়ুয়া পাড়া থেকে সাতটা কল্পজাহাজ অংশগ্রহণ করেছে বলে জানান রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা ও কল্প জাহাজ ভাসা উৎসব উদ্যাপন পরিষদের যুগ্ম–আহ্বায়ক উচ্ছাস বড়ুয়া।
কঙবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষ পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, ১৯৫৬ সালের আগ পর্যন্ত তৎকালীন রাখাইন এবং মঘ সম্প্রদায় রামুর বাঁকখালী নদীতে কল্পজাহাজ ভাসানো উৎসব উদযাপন করতেন। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে তাদের আধিক্য কমতে শুরু করলে বড়ুয়া বৌদ্ধরা এর হাল ধরেন। এই উৎসব সর্বপ্রথম প্রবর্তন হয় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে। প্রায় দুইশত বছর আগে মিয়ানমারের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান নামক একজন ব্যক্তি এই উৎসবের সূচনা করেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপার্সন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া, কঙবাজার জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মান্নান, পুলিশ সুপার মো. সাইফুদ্দিন শাহিন, সাবেক এমপি লুৎফুর রহমান কাজল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ফোরাম, কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক সাথি উদয় কুসুম বড়ুয়া বক্তৃতা করেন।
এদিকে বৃহৎ আয়োজনে কঙবাজার সমুদ্র সৈকতেও জাহাজ ভাসা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে হাজার হাজার দর্শনার্থী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।