নগরীর আবাসনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে সৃষ্ট চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করলেও পুরোপুরি সরে এসেছে আবাসন থেকে। সিডিএ ফ্লাইওভার করেছে, করছে আউটার রিং রোডের মতো প্রকল্প, নির্মাণ করছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু গত ১৫ বছরেও কোনো আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়নি। এতে করে নগরীর আবাসন খাতে সিডিএর ভূমিকা ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য সিডিএর গড়ে তোলা আবাসিক এলাকায় শত শত প্লট খালি পড়ে থাকায় ভবিষ্যতে নয়া আবাসিক এলাকা করলেও তা নগরীর আবাসনে ঠিক কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। শুরুতে আবাসনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হলেও ক্রমে সিডিএ তা থেকে সরে এসেছে। নগরীতে দিনে দিনে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে আবাসন সংকট। কিন্তু গত ১৫ বছরে সিডিএ একটিও আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেনি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নগরীতে ১২টি আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্যে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ৫৮টি, ১৯৬৫ সালে করা আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ৩৯১টি, ১৯৭৩ সালে করা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ৭৫৯টি, ১৯৭৭ সালে করা কর্ণেল হাট সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ১৬৮টি, ১৯৮৪ সালে করা সলিমপুর সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ৯০৪টি, ১৯৯৫ সালে করা কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্পে প্লটের সংখ্যা ৫১৭টি, ২০০০ সালে করা চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ১৮০টি, ২০০২ সালে করা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা দ্বিতীয় পর্যায়ে প্লটের সংখ্যা ৮২টি, ২০০৬ সালে করা কল্পলোক আবাসিক এলাকায় প্রথম পর্যায়ে প্লটের সংখ্যা ৪২৩টি, ২০০৭ সালে করা কল্পলোক আবাসিক এলাকা দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৩৫৬টি, ২০০৮ সালে করা অনন্যা আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ১৪৭৮টি এবং ২০০৯ সালে ষোলশহর পূনর্বাসন এলাকায় সিডিএ ৪৮টি প্লট বরাদ্দ দেয় ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের। শুরু থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সিডিএ সর্বমোট ৬৩৬৪টি প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। এরপরে সিডিএ আর কোনো আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেনি।
সিডিএর দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, নগরীর আবাসন সংকট ঘুচাতে সিডিএ প্লট বরাদ্দ দিলেও বিভিন্ন আবাসিক এলাকাতে শত শত প্লট খালি রয়েছে। কোনো কোনোটিতে একের পর এক প্লট হাতবদল হচ্ছে। মূল্য বাড়ছে। অথচ সিডিএ যেই মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল সেটি অর্জিত হয়নি। তাই সিডিএ আবাসন খাতে কাজ করার পরিবর্তে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অন্যান্য খাতে কাজ শুরু করে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটের উন্নয়নে সিডিএ নিরলসভাবে কাজ করেছে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, সিডিএ নগরীতে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার করেছে। রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ করেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। নগরীর যান চলাচলে ব্যাপক গতিশীলতার পাশাপাশি বহু এলাকার চেহারা পাল্টে দেয়া আউটার রিং রোড নির্মাণ করছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এগুলোর প্রত্যেকটিই প্রকল্পই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জনসম্পৃক্ত। নগরীর জীবনমান উন্নয়নে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিরলসভাবে কাজ করছে বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার জন্য সিডিএ বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু জায়গার মূল্য এতো বেড়ে গেছে যে, আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। বিশেষ করে প্লট বিক্রি করে খরচ উঠানো সম্ভব হবে না। তারা বলেন, নগরীর প্রতিটি মৌজারই মৌজা ভ্যালু বেড়ে গেছে। প্রচলিত নিয়মে মৌজা ভ্যালুর তিনগুণ দাম পরিশোধ করে জমি হুকুমদখল করতে হয়। এতে সস্তায় প্লট দেয়ার সুযোগ একেবারেই রুদ্ধ হয়ে গেছে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সিডিএর পক্ষে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা উল্লেখ করেন।
সিডিএর দুইটি আবাসিক এলাকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। অপরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়ার ফলে সিডিএর সলিমপুর আবাসিক এলাকা এবং কর্ণফুলী আবাসিক এলাকা প্রায় পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা সলিমপুর আবাসিক এলাকায় ৯০৪টি প্লট থাকলেও অধিকাংশ প্লটই খালি পড়ে আছে। শহর থেকে দূরে এবং নাগরিক সুযোগ সুবিধা না থাকায় এখানে কেউ বাড়িঘর নির্মাণে আগ্রহী নয়। অপরদিকে নদীর ওপারের কর্ণফুলী আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। প্লট রয়েছে ৫১৭টি। আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠার দুই যুগ অতিক্রান্ত হলেও একটি বাড়িও এই আবাসিক এলাকায় নির্মিত হয়নি। বাড়িঘর করার কোনো পরিবেশই ওই আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেনি। পানি সংকটে পুরো এলাকাটি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। কল্পলোক আবাসিক এলাকা এবং অনন্যা আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা হয়েছে দশ বছরেরও বেশি আগে। অথচ বাড়ি ঘর নির্মিত হয়নি বললেই চলে। কল্পলোক আবাসিক এলাকায় বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বাড়িঘর নির্মাণ শুরু হলেও এখনো শত শত প্লট খালি। সবকিছু মিলে চট্টগ্রামে গড়ে তোলা ১২টি আবাসিক এলাকায় দুই তৃতীয়াংশ প্লটই খালি পড়ে আছে। প্লট বরাদ্দের পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাড়িঘর নির্মাণ করা না হলে প্লট বাতিলের আইন থাকলেও তা কার্যকরের কোনো রেকর্ড নেই বলে উল্লেখ করে সূত্রগুলো বলেছে, বহু প্লট খালি পড়ে রয়েছে। তাই নতুন আবাসিক এলাকা করলে যে আবাসনে কোনো ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে তা বলা যাচ্ছে না। তার থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সিডিএর যে যাত্রা তা অব্যাহত থাকলে নগরবাসী উপকৃত হবে।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী