বহুমাত্রিক মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী

তহুরীন সবুর ডালিয়া | মঙ্গলবার , ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন তাঁর সময়ের একজন অগ্রসর সাহসী চিন্তাবিদ, ধর্মপ্রচারক, সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, শিক্ষা সম্প্রসারণের অগ্রদূত, সাংবাদিক, সর্বোপরি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন আপোষহীন জাতীয়তাবাদী নেতা।

চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ) উপজেলার আড়ালিয়া গ্রামের এক প্রখ্যাত আলেম পরিবারে ১৮৭৫ সালে এই মনীষীর জন্ম। তাঁর বাবা মুন্সী মতিউল্লাহ্‌ ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ আরবী ও ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সুপন্ডিত বাবার তত্ত্বাবধানে শিক্ষা জীবন শুরু করে পরবর্তীতে হুগলী ও কলকাতা মাদ্রাসা আলিয়া থেকে জমাতে উলা বা টাইটেল পাস করে মওলানা উপাধি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন রংপুর মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। রংপুর থাকাকালে ভারত উপমহাদেশ ও এর বাইরের দেশে বহু জ্ঞানী গুনী মানুষের সংস্পর্শে এসে মওলানা মনিরুজ্জামানের ভেতরে এই চেতনার উন্মীলন ঘটে যে, অভিভক্ত বাংলার সাধারণ মুসলিম জনগণের অন্ধত্ব, অশিক্ষা, গোঁড়ামী, দারিদ্রতা দূর করতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাঁর প্রয়াস প্রচেষ্টায় উত্তরবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা। চট্টগ্রামের কদম মোবারক মুসিলম এতিমখানা, কদম মোবারক এম ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয় ও বরকল এস জেড উচ্চ বিদ্যালয় তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান।

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার আনার প্রয়াসী ছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে তাঁর সুচিন্তিত মতামত ছিল-‘মাদ্রাসা শিক্ষায় ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি, বাংলা, গণিত, ইতিহাস ও ভূগোলের কিছু কিছু বিষয় সংযুক্ত করতে হবে।’ অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার বিষয়ে তিনি বরাবর সোচ্চার ছিলেন।

মওলানা মনিরুজ্জামানের শিক্ষকতার জীবন খুব দীর্ঘ নয়। রংপুর ও সীতাকুন্ড মাদ্রাসা মিলে মাত্র ১০ বছর। সীতাকুন্ড থাকাকালে তিনি অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম শিক্ষা কনফারেন্স, বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি, প্রাদেশিক মোছলেম শিক্ষা সমিতি ও পরবর্তীতে আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙালাহ প্রতিষ্ঠা করেন।

শিক্ষকতাকালে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মিশর, লক্ষ্ণৌ ও দিল্লীর পত্র পত্রিকায় প্রথমত আরবী ও উর্দু ভাষায় লিখালিখি করতেন। তারপর তিনি উপলব্ধি করলেন, পরাধীন ভারতের বঞ্চিত অনগ্রসর মুসলিম সমাজের জাগরণে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। সীতাকুন্ডে শিক্ষকতার চাকরী ছেড়ে তখন তিনি কলকাতায় সাপ্তাহিক সোলতান পত্রিকায় যোগ দিলেন। পরবর্তীতে এই পত্রিকাটি তাঁর হাতে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তিত হয়। তিনি হাবলুর মতিন (১৯১২), মুহাম্মদী (১৯০৩), কোহিনূর (১৯১১) , বাসনা (১৯০৪) ও আলএসলাম (১৯১৩) পত্রিকার সম্পাদনা বা প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি রাজনীতি শুরু করেন। ১৯০৬ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে বঙ্গবঙ্গ রদ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। মওলানা মনিরুজ্জামান এটি বুঝেছিলেন, অবিভক্ত বাংলার সাধারণ মুসলিম জনগণকে জাগাতে হলে সংবাদপত্রে লিখালিখি ও প্রচার প্রচারণা বাড়াতে হবে। লেখালেখি ও বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামের বাণী প্রচার করতে হবে। আর এইজন্য বাংলা ভাষার কোন বিকল্প নাই। ফারসী বা আরবী ভাষার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের গোঁড়ামী, কুসংস্কার দূর করা বা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের চেতনাবোধ জাগ্রত করা সম্ভব নয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ব্যতীত সম্ভব নয় সাধারণ জনচিত্তে পৌঁছানো, তাদের প্রভাবিত ও জয় করা, সম্ভব হবে না জনগণকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলা। তাই তিনি দু’হাতে লিখতে শুরু করলেন বাংলা প্রবন্ধ, প্রকাশিত হতে লাগল গ্রন্থসমূহ। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ তিনি বাংলায় করেছেন। তাঁর লেখনী ও বক্তৃতার ভাষা ছিল গণমানুষের কাছাকাছি। সাহিত্যই সব ভাব প্রকাশের বাহন এ সম্বন্ধে মওলানা ইসলামাবাদী পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মানুষের চিত্ত জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে বার্মা থেকে কলকাতা আসাম পর্যন্ত।

বাংলা ভাষার রূপ কেমন হবে? এ সম্পর্কে ইসলামাবাদী তাঁর সম্পাদিত আল এসলাম পত্রিকার ১৩২৭ সালের শ্রাবন সংখ্যায় মত প্রকাশ করেন-‘পুঁথি সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক বাংলা সাহিত্য এই দুইয়ের মাঝখানে হবে আমাদের বাংলা ভাষার স্থান।’ বাংলা ভাষার প্রতি মওলানা ইসলামাবাদীর ছিলো অপরিসীম মমত্ববোধ। ভারতের সাধারণ ভাষা কি হবে? হিন্দি না উর্দু! বিশ শতকের শুরুতে এমন বিতর্কের মাঝে সুস্পষ্টভাবে তিনি মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে মত রাখেন ও এ সম্পর্কে লেখালেখি ও বক্তৃতা বিবৃতি দেন। মওলানা মনিরুজ্জামানের বাংলা ভাষার প্রতি এই জোরালো আবেগ ও সমর্থন পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলো। তিনি ১৯২২ ও ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে জাকজমকপূর্ণভাবে সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠান করেন।

মওলানা ইসলামাবাদী নারী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বাংলার মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা ও কল্যাণের পথে আহ্বান জানিয়ে ‘আল এসলাম’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘যখন পুত্র কন্যার মা হইবে, তখন সর্বদা তাহাদিগকে শুধু অলংকার পরাইবার চেষ্টায় লাগিয়ে থাকিও না। যে অলংকার স্থায়ী নহেতাহাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করিও, সভ্যতা শিক্ষা দিও।’

কর্মবীর দেশপ্রেমিক এই নেতা সমাজকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একেবারে নীচের ধাপ থেকেযেখানে রয়েছে দেশের ও অর্থনীতির মূল শেকড়। তাই ইসলামাবাদীর একদিকে যেমন কাম্য ছিলো কৃষক শ্রমিকের উন্নতি তেমনি যেসব অত্যাবশ্যকীয় বৃত্তির প্রতি মুসলিম সমাজের অনীহা ছিলো, তিনি চেয়েছিলেন তার প্রতিও মুসলিম সমাজকে আগ্রহী করে তুলতে। তিনি প্রায় বলতেন, মুসলমানরা যদি কর্মকার, কুম্ভকার, গোয়ালা, ময়রা বাবুজীবীর ব্যবসায় অবলম্বন করে তাহাও দেশেরই সেবা। ইহাতে হিন্দুদের অসন্তোষের কোন কারণ নাই। (: আবদুল গফুর সিদ্দিকী)

মওলানা ইসলামাবাদীর গভীর আস্থা ছিলো আলেম সমাজের উপর। এটি তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিম সমাজের প্রতিদিনকার জীবনাচরণ অর্থাৎ জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ও প্রতিদিনকার অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যার পরিচালক স্বভাবতই আলেম সমাজ, ধর্মীয় নেতা হিসেবে জনসাধারনের উপর যাদের প্রভাব অপরিসীমএ আলেম সমাজকে যদি সংঘবদ্ধ করে দেশ সমাজের আশু সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করে তোলা যায়, তাহলে এদের দিয়ে অসাধ্য সাধন করা যাবে। মুসলমান সমাজ যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন আর যেসব অন্তহীন বাধাবিপত্তি সমাজকে পঙ্গু আর নির্জীব করে রেখেছে ইচ্ছা করলে এরাই তার বন্ধন থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে পারে। (কথা সাহিত্যিক আবুল ফজল) আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙালাহ’ এই পরিকল্পনারই বাস্তব রূপ। সংগঠনটির মুখপত্র আল এসলামমওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত প্রথম স্বাধীন পত্রিকা, যা ১৯১৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।

একটি জাতীয় আরবী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিলো তাঁর আমৃত্যু। ‘তাঁর আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ছিলো ধর্ম শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও যুক্তিবাদের প্রসারের সাথে সাথে তাদের পরিশ্রমী, সংযমী ও স্বাধীনতাকামী করে গড়ে তোলা এবং এভাবে সমাজ ও দেশের বৃহত্তর কর্তব্যের দ্বারে পৌঁছে দেয়া। (শামসুজ্জামান খানমাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী) এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সাথে কারিগরি ট্রেনিং ও হাঁসমুরগির খামার নির্মাণ প্রকল্পসহ বাস্তব জীবনভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

চট্টগ্রাম শহরের অদূরে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব দক্ষিণ তীরবর্তী সুপ্রাচীন বন্দর শহর দেয়াং। এর পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে মতবিরোধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পাকিস্তান আন্দোলনসহ নানা ঘটনা পরম্পরায় আরবী বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। এ নিয়ে আমৃত্যু আক্ষেপ ছিলো তাঁর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদান, আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে সম্পর্ক, ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে বার্মায় গিয়ে সাক্ষাৎ ও বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী তৎপরতার দায়ে ১৯৪৪ সালের ১৩ অক্টোবর ৭০ বছর বয়সী মওলানা গ্রেফতার হন চট্টগ্রাম থেকে। বৃটিশ সরকার তাঁকে মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু ও অন্যান্য নেতাদের সাথে দিল্লীর লালকিল্লায় বন্দী করে রাখেন। পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় পাঞ্জাবের ময়াওয়ালী জেলে। সেখানকার জেলের ছাদের বিমের সাথে রশি বেঁধে তাঁর উপর অশেষ নির্যাতন চালানো হয়েছিলো গোপন তথ্য জানার জন্য। প্রায় ১১ মাস কারানির্যাতন ভোগ করে মুক্তির পর মওলানা মনিরুজ্জামান কলকাতায় পক্ষঘাত রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৫০ সালের ২৪ শে অক্টোবর জীবনের বহু স্বপ্নসাধ অসম্পূর্ণ রেখে এই অসামান্য কর্মবীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আজ থেকে ১০০ বছরেরও অধিক সময় পূর্বে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মুসলিম সমাজের যে অন্ধত্ব কুসংস্কার, কুপমন্ডুকতা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। সেই অবস্থা থেকে বৃহৎ পরিসরে উত্তীর্ণ হওয়া আজো আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি বরং মানবিক মূল্যবোধ, পরার্থপর সহিষ্ণুতা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। এই মানবতাবাদী মহান নেতার অনুসরনীয় দেশপ্রেম তাঁর আদর্শ ন্যায়বোধ তাঁর সুদুরপ্রসারী চিন্তাকে নতুন করে উপলদ্ধি করার ও তরুন প্রজন্মের সামনে তাকে উপস্থাপন করা আজ একান্তই জরুরী।

মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সমাধির গায়ে লিখা আছে তাঁর একটি ফার্সি কবিতার বাংলা অনুবাদ :

পথিক; ক্ষণিকের তরে বস মোর শিরে

ফাতেহা পড়িয়া যাও নিজ নিজ ঘরে

যে জন আসিবে মোর সমাধির পাশে

ফাতেহা পড়ে যাবে মম মুক্তির আশে।

অধম মনিরুজ্জামান নাম আমার

এসলামাবাদী বলে সর্বত্র প্রচার।”

তথ্য সূত্র: . কল্যাণকামী আপোষহীন ব্যক্তিত্ব মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীআহমদ মমতাজ। ২. মওলানা ইসলামাবাদী : আবুল ফজল।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, মহিলা কলেজচট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বিজয়া দশমী
পরবর্তী নিবন্ধ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় বইমেলা’: স্থানীয় লেখক ও নাগরিক-সমাজের অংশগ্রহণ জরুরি ছিলো