জুবিন গার্গ (১৮ নভেম্বর ১৯৭২ – ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) একজন ভারতীয় সঙ্গীত এবং সংস্কৃতি অঙ্গনে এক ব্যতিক্রমী নক্ষত্র। তিনি শুধুমাত্র একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে সুরকার, গীতিকার, যন্ত্রবাদক, অভিনেতা, পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, কবি এবং সমাজসেবী। অসমীয়া, বাংলা এবং হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত শিল্পে তাঁর প্রধান কাজের ক্ষেত্র হলেও, তিনি ৪২টিরও বেশি ভাষা ও উপভাষায় গান গেয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, আদি, বড়ো, ডিমাসা, ইংরেজি, গোয়ালপাড়িয়া, গুজরাটি, কন্নড়, কার্বি, মালয়ালম, মারাঠি, মিসিং, নেপালী, ভোজপুরি, ওড়িয়া, সংস্কৃত, সিন্ধি, তামিল, তেলুগু, তিওয়া এবং উর্দু। ৩৩ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে তাঁর রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা ৩৮,০০০ এরও বেশি, যা তাঁকে আসামের অন্যতম প্রভাবশালী এবং সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
গার্গ ছিলেন একজন সত্যিকারের বহু–যন্ত্রবাদক। তিনি আনন্দলহরী, ঢোল, দোতারা, ড্রামস, গিটার, হারমোনিকা, হারমোনিয়াম, ম্যান্ডোলিন, কিবোর্ড, তবলা এবং বিভিন্ন পারকাশন যন্ত্রসহ বহু বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৮ নভেম্বর মেঘালয়ের তুরাতে এক অসমীয়া ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। বিশ্বখ্যাত সুরকার জুবিন মেহতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর নাম রাখা হয় ‘জুবিন‘। প্রথম জীবনে তাঁর পদবি ‘বড়ঠাকুর‘ থাকলেও, পরবর্তীতে তিনি তাঁর ব্রাহ্মণ গোত্রের উপাধি ‘গার্গ‘ ব্যবহার করা শুরু করেন।
তাঁর বাবা মোহিনী মোহন বড়ঠাকুর ছিলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং ‘কপিল ঠাকুর‘ ছদ্মনামের কবি, আর মা ইলি বড়ঠাকুর ছিলেন গায়িকা। মা–ই ছিলেন তাঁর সঙ্গীতের প্রথম গুরু, যাঁর কাছে তিনি মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই গান শেখা শুরু করেন। পণ্ডিত রবিন ব্যানার্জীর কাছে তিনি ১১ বছর ধরে তবলা শিখেছিলেন এবং গুরু রমণী রায়ের মাধ্যমে অসমীয়া লোকসঙ্গীতের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। তিনি গুয়াহাটির বি. বরুয়া কলেজে ব্যাচেলর অফ সায়েন্সে ভর্তি হলেও, সঙ্গীত জীবনে মনোনিবেশের জন্য পড়াশোনা অসমাপ্ত রাখেন। পারিবারিক জীবনে ২০০২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার গরিমা সাইকিয়াকে বিয়ে করেন।
জুবিন গার্গের পেশাদার সঙ্গীত জীবনের সূচনা ঘটে ১৯৯২ সালে তাঁর প্রথম অসমীয়া অ্যালবাম ‘অনামিকা‘-এর মাধ্যমে। এরপর ‘সাপোনোর সুর‘, ‘জোনাকি মন‘, ‘মায়া‘, ‘আশা‘ এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল বিহু অ্যালবাম ‘উজান পিরীতি‘ তাঁকে উত্তর–পূর্ব ভারতে এক জনপ্রিয় মুখ করে তোলে।
১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি মুম্বাই পাড়ি জমান। বলিউডে তাঁর ইন্ডিপপ একক অ্যালবাম ‘চাঁদনি রাত‘ এবং পরবর্তীতে ‘চান্দা‘, ‘জলওয়া‘, ‘স্পর্শ‘-এর মতো অ্যালবামগুলো প্রকাশিত হয়। তবে বলিউডে তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে ২০০৬ সালে ‘গ্যাংস্টার‘ চলচ্চিত্রের ‘ইয়া আলি’ গানের মাধ্যমে, যার জন্য তিনি সেরা নেপথ্য গায়কের গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস (এওঋঅ) জিতেছিলেন। বাংলা সঙ্গীত জগতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ২০০৩ সালে ‘মন‘ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাঁর বাংলায় আত্মপ্রকাশ হয়। এরপর ‘শুধু তুমি‘ (যেটির তিনি সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন), ‘প্রেমী‘, ‘মন মানে না‘, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার‘ ও ‘লাভ স্টোরি‘র মতো চলচ্চিত্রে তাঁর গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবেও সফলতা পান। ২০০০ সালে ‘তুমি মোর মাথো মোর‘ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাঁর পরিচালনার শুরু। এছাড়াও তিনি ‘দিনবন্ধু‘, ‘মন যায়‘, ‘গানে কি আনে‘, ‘মিশন চায়না‘, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘ এবং ‘ড. বেজবরুয়া ২‘-এর মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
জুবিন গার্গ তাঁর সাহসী, স্পষ্টভাষী মনোভাব এবং বিতর্কমূলক মন্তব্যের জন্য প্রায়শই সংবাদের শিরোনামে এসেছেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর খোলামেলা মন্তব্য তাঁকে একদিকে যেমন সমালোচনা এনে দিয়েছে, তেমনই অন্যদিকে তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে এক আইকনে পরিণত হন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল: “মই ঘেন্টা কাকু খাতির নকোরু, ইউ কান্ট ডিকটেট মি” (আমি কাউকে পরোয়া করি না, তুমি আমাকে নির্দেশ দিতে পারো না)। আসামের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী আন্দোলনের একজন প্রধান অরাজনৈতিক মুখ ছিলেন তিনি। তাঁর ‘পলিটিক্স নোকরিবা বন্ধু‘ গানটি এই আন্দোলনের গণ–সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল।
তাঁর জনহিতকর কাজগুলিও ছিল বিশাল। তিনি কলাগুরু আর্টিস্ট ফাউন্ডেশন নামে একটি দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করতেন এবং আসামে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সংগ্রহে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ২০২১ সালে কোভিড–১৯ এর সময় তিনি তাঁর গুয়াহাটির দোতলা বাড়িটিকে কোভিড কেয়ার সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
২০২৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, সিঙ্গাপুরে সমুদ্রে লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই সাঁতার কাটার সময় আকস্মিক দুর্ঘটনায় জুবিন গার্গ মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ ভারতজুড়ে গভীর শোকের ছায়া ফেলে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বহু রাজনৈতিক নেতা ও সঙ্গীত জগতের ব্যক্তিত্বরা শোক প্রকাশ করেন। আসাম সরকার তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চার দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে।
জুুবিন গার্গের শেষ যাত্রাকে লিমকা বুক অফ রেকর্ডস অনুসারে বিশ্বব্যাপী চতুর্থ বৃহত্তম জনসমাবেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যা মাইকেল জ্যাকসন, পোপ ফ্রান্সিস ও রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষ বিদায়ের সমতুল্য। অসমীয়া সঙ্গীত ও সিনেমায় জুবিনের অবদান অসামান্য। লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও সংরক্ষণবিদদের প্রচেষ্টায় তাঁর প্রায় ৩৫,০০০ গান সমন্বিত একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করা হয়েছে। তিনি একাধারে সঙ্গীত, সিনেমা এবং সামাজিক সক্রিয়তার মাধ্যমে উত্তর–পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক পটভূমিতে যে গভীর ছাপ রেখে গেছেন, তার জন্য তিনি চিরকাল ‘একটি প্রজন্মের কণ্ঠস্বর‘ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক












