চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনীয় লাইটারেজ জাহাজের অভাবে রেশনিং করে জাহাজ বরাদ্দ দেয়ায় এই সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। বিদেশ থেকে হাজার হাজার টন পণ্য নিয়ে আসা মাদার ভ্যাসেলগুলো থেকে পণ্য খালাসে প্রয়োজনীয় লাইটারেজ জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে একটি বা দুইটি করে লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এতে আমদানি বাণিজ্যের ব্যয় বৃদ্ধিসহ দেশ থেকে লাখ লাখ ডলার চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। একই সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজজট দেখা দেয়ারও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের আমদানি বাণিজ্যের আমদানিকৃত বছরে ১০ কোটি টনেরও বেশি পণ্য হ্যান্ডলিং হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। প্রতি বছর এর পরিমাণ বাড়ছে। প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশেরও বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডলিংকৃত পণ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যসহ অন্তত ৫ কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয় বহির্নোঙরে। প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজের সাহায্যে এই বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবাহিত হয়। বিশ্বের নানা দেশ থেকে লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদারভ্যাসেলগুলো বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারেনা। এসব বড় জাহাজ থেকে পণ্যগুলো বহির্নোঙরেই লাইটারেজ জাহাজে বোঝাই করা হয়। মাদার ভ্যাসেলের ক্রেনের সাথে গ্রাভ ব্যবহার করে লাখ লাখ টন পণ্য নামানো হয় লাইটারেজ জাহাজে। এক একটি মাদার ভ্যাসেলে একই সাথে তিন চারটি লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করার সুবিধা থাকে। মাদার ভ্যাসেল থেকে নামানো পণ্য কর্ণফুলী নদীর ষোলটি ঘাটের পাশাপাশি দেশের ৩০টিরও বেশি গন্তব্যে প্রেরণ করা হয়।
অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরের নির্দিষ্ট রুট অনুসরণ করে লাইটারেজ জাহাজগুলো পণ্য পরিবহন করে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজগুলোর সিংহভাগই বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন বার্থিং সভা করে বিডব্লিউটিসিসি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে চাহিদানুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেয়। যেগুলো বহির্নোঙরে গিয়ে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস করে। অপরদিকে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন জাহাজগুলো ডিব্লিউটিসিসি’র সিরিয়ালভুক্ত না হয়ে নিজেদের পণ্য নিজেরাই পরিবহন করে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের পাশাপাশি বন্দরের ভিতরেও জাহাজের ওভারসাইড থেকে পণ্য পরিবহন করে লাইটারেজ জাহাজগুলো। আবার বহির্নোঙরে ড্রাফট কমানোর জন্যও কিছু পণ্য লাইটারেজ জাহাজে খালাস করা হয়। পরবর্তীতে ড্রাফট কমানোর পর ওই জাহাজটি বাকি পণ্য বন্দরের জেটিতে এসে পণ্য খালাস করে।
সবকিছু মিলে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহন এবং দেশব্যাপী সাপ্লাই চেইন ঠিকঠাক রাখার জন্য লাইটারেজ জাহাজ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে বহু বছর ধরে। ঠিকঠাকভাবে লাইটারেজ জাহাজ পাওয়া না গেলে বহির্নোঙরে বিদেশ থেকে আসা মাদার ভ্যাসেলের অবস্থানকাল বেড়ে যায়। এক একটি মাদার ভ্যাসেল একদিন অলস বসে থাকলে অন্তত ১৫ হাজার ডলার ফিঙড অপারেটিং কস্ট বা এফওসি গচ্ছা দিতে হয়। যার যোগান দিতে হয় আমদানিকারককে। যা ঘুরপথে সাধারণ ভোক্তাদের উপরই পড়ে। তাছাড়া জাহাজজটে বিশ্বের শিপিং সেক্টরে বন্দরের ইমেজও সংকটে পড়ে।
কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভ্যাসেলগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করে একাধিক পণ্যের এজেন্ট জানিয়েছেন যে, তাদের মাদার ভ্যাসেলগুলো মার খাচ্ছে। জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। একটি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে ৩/৪টি করে জাহাজ বরাদ্দ চাওয়া হলেও দেয়া হচ্ছে দুইটি করে। কোন কোন জাহাজকে দেয়া হয়েছে একটি। এতে করে পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রম অর্ধেকে নেমে আসার শংকা ব্যক্ত করেন তারা। তারা বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি লাগাতার হলে বন্দরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে জটের সৃষ্টি হবে। বহির্নোঙরে অবস্থানকারী জাহাজগুলোর বিপরীতে লাখ লাখ ডলার গচ্ছা হিসেবে দেশ থেকে চলে যাবে।
গতকাল ৪০টি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে লাইটারেজ জাহাজ চাওয়া হয়। এগুলোর কোন কোনটিকে দুইটি এবং কোনটিকে একটি করে জাহাজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে অধিকাংশই পণ্যের এজেন্ট অভিযোগ করেছেন যে, তারা প্রয়োজনীয় লাইটারেজ জাহাজ পাননি।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে গম, ডাল, সরিষা, লবণ, সয়াবিন ভূষি, রড, এইচ আর কয়েল, কয়লা, স্ল্যাগ, পাথর, ইউরিয়া, ডিএপি সার, এমওপি সার, টিএসপি সার, কোপ্রা, উডপাম্পসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে মাদার ভ্যাসেল অবস্থান করছে। বিডব্লিউটিসিসির একজন কর্মকর্তার সাথে জাহাজ বরাদ্দ সংক্রান্তের রেশনিং নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা প্রতিটি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে দুইটি করে জাহাজ দিয়েছি। অনেকেই বেশি জাহাজ চেয়েছে। আবার কেউ কেউ বাড়তি জাহাজ নিয়ে লোড করতে নেন না। এই ধরণের পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় সে জন্য আমরা রেশনিং করছি। জাহাজের কিছু সংকটের কথা স্বীকার করে ওই কর্মকর্তা বলেন, অনেকগুলো জাহাজ পণ্য নিয়ে অলস সাগরে ভাসছে। আমদানিকারকেরা পণ্যগুলো খালাস করছে না। আবার কোন কোন জাহাজ পছন্দের পণ্য না পেলে লোড করতে চায়না। এতে করে সিরিয়ালে জাহাজের সংখ্যা কমে গেছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
তবে রেশনিং পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না ঘটলে সংকট বাড়বে বলে উল্লেখ করে একাধিক আমদানিকারক বলেছেন, আমরা সময়মতো পণ্য খালাস করতে না পারলে বিদেশি জাহাজগুলোকে কোটি কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হবে। যার খেসারত আমাদের ব্যবসার উপর পড়বে। এতে বন্দরের ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।