বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ৩১ মে, ২০২১ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

উল্টো থেকে দেখা
আমি সরকারি কলেজে চাকরি করার সময়, কলেজের ডিগ্রী (পাস) কোর্স, অনার্স মাস্টার্স কোর্সসমূহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্ত ছিল। তখন সরকারি কলেজের সংখ্যা খুব কম ছিল। সীমিত সংখ্যক কলেজে অনার্স কোর্স ছিল। মাস্টার্স কোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়তে হতো। চট্টগ্রামে দুইটি কলেজে অনার্স কোর্স চালু ছিল, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ এবং গভঃ কলেজ অব কমার্স। এটি অনেক পুরানো আমলের কথা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতা থেকে বেরিয়ে সরকারি বেসরকারি কলেজে অনার্স মাস্টার্স কোর্সগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় চলে আসে। ১৯৮০’র দশকের শুরু থেকে ব্যাপকভাবে বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করার পর সরকারি কলেজের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। তার পূর্বেও কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছিল তবে তা সংখ্যায় খুব কম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে সারা দেশে কলেজগুলোতে অনার্স মাস্টার্স খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটিতে আমরা কলেজ শিক্ষকেরা বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পেতাম। একবার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা কমিটির সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে যাই। পরীক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ এবং কিছু একাডেমিক কাজের জন্য আমাকে দুই তিনদিন গাজীপুরে থাকতে হয়েছিল। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের একজন কর্মকর্তা আমাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত তাদের রেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তিনদিন আমাকে সেখানে থাকতে হয়েছিল। পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ ছাড়াও আমার সাথে তিনদিন পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল। রাত্রে আমি খাওয়া দাওয়ার পরে আমার বিছানায় শুয়েছিলাম। নির্জন ঐ কক্ষে ঘুম আসছিল না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আমি দরজা খুললাম। সুদর্শন, দামী কাপড় চোপড় পরা এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলো। উনার বয়স আমার চাইতে কম হবে বলে আমার মনে হলো। উনি আমাকে বললেন, আপনি তো চট্টগ্রামের একটি সরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল, তাই না? আমি বুঝতে পারলাম উনি আমার খোঁজ খবর নিয়ে তারপর আমার কাছে এসেছেন। হয়তো বা উনি আমার পাশের কক্ষে উঠেছেন। সম্ভবত তিনি অফিসিয়াল কোনো দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। উনার পরিচয় জানা গেলো। উনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কথা শুরু হওয়ার পরে আমি বুঝতে পারলাম উনার ভিতরে তিনটি ভালো গুণ আছে, উনি নিরহংকার, অন্য মানুষের সাথে আলাপ জমাতে পটু, উনি উনার বিষয়ের বাহিরেও ব্যাপকভাবে জ্ঞানচর্চা করেন। উনার গবেষণার সাফল্য কাহিনীগুলো যখন আমি জানতে পারলাম এবং বিদেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে উনার সম্মানের বিষয়টি যখন আমার নজরে এলো তখন আমি মনে মনে বললাম-সাবাশ বাংলাদেশ।
আমরা অনেক রাত পর্যন্ত কথা বললাম। আমার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেলো। উনি কথা বলার জন্য আমার মতো একজন শ্রোতা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। উনি উনার রুমে গিয়ে ফ্লাঙ ভর্তি চা নিয়ে আসলেন। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল এ রাতে উনি আর ঘুমাবেন না। আমি উনাকে বললাম, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদটি আপনার জন্য যথার্থ পদ। কারণ আপনি উপাচার্য হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষতা আনতে পারবেন। কেরানী, সেলসম্যান, আমলা তৈয়ারির কারখানার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষক তৈয়ারির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারতেন। আপনি যদি আপনার নিজের ব্যবহারের জন্য একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালান তাহলে অবশ্যই আপনার পার্শ্ববর্তী মানুষ তার আলো পাবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি বৈদ্যুতিক বাতির চাইতেও বেশি আলো ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়টির চারিপাশে যত মানুষ বসবাস করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবে জ্ঞান বিজ্ঞান, নান্দনিকতা, ন্যায়নিষ্ঠা, সাহসিকতা, উঁচু কন্ঠস্বরে কথা বলার শক্তি অর্জন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো নলেজ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে জনমানুষের সাথে নলেজ শেয়ার করা। ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করা। স্টেইক হোল্ডারদের সাহায্য নিয়ে জ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। আপনার মতো মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলে সে রাস্তা খুলে যেতো বলে আমি মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে পত্রিকায় নেতিবাচক সংবাদ দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মুখে অসুন্দর ভাষা শুনলে তাতেও আমার কষ্ট হয়। প্রফেসর সাহেব কিছুক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, আমি আমার কাজের উপরে, আমার গবেষণা কর্মের সাফল্যের উপরে, দেশের প্রতি আমার ভালোবাসার উপর নির্ভর করতে চাই। পলিটিক্যাল সাপোর্টের উপরে ভর করে উপাচার্য হতে চাই না। মন্ত্রী হতে হলে পলিটিক্যাল সাপোর্টের দরকার হয়। উপাচার্য হওয়ার জন্য প্রয়োজন বিশ্বমানের দৃষ্টিভঙ্গি। উনি বললেন, আমি উপাচার্য হওয়ার জন্য দরখাস্ত নিয়া যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের কাছে ধর্না দিয়ে সুপারিশ লেখাতে পারবো না। আমি বললাম, আপনার সাথে পরিচিত হওয়া আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। আপনি আমাদের চাইতে অনেক বেশি যোগ্য। যোগ্য অধ্যাপকেরা আছেন বলেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ভালোভাবে কাজ করছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য হলো, আমি কখোনই আপনাকে উপাচার্য হিসেবে দেখতো পাবো না। কারণ আপনি মন্ত্রীদের দরজায় ধর্ণাও দিবেন না, উপাচার্যও হতে পারবেন না। এ আফসোস আমার মন থেকে যাবে না। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। উপাচার্যের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উপাচার্যের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। আমার চেনা জানা অনেক উপাচার্য আছেন যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
অধ্যাপক সাহেবের সাথে কথা বলে আমার মনে হলো তিনি সব বিষয়গুলো প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে উল্টোদিক থেকে চিন্তা করেন। উপাচার্য হওয়ার জন্য সবাই তদবির করে, কিন্তু উনি তার উল্টো। এই উল্টো লোকেরা কি ধাপে ধাপে শীর্ষস্থানের দিকে এগুতে পারে? উনার সাথে আমার রেমিটেন্স আয় নিয়ে কথা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা শক্তিশালী হওয়ার পিছনে মূল যোগানদার হলো প্রবাসীরা এবং গার্মেন্টস উদ্যোক্তারা। শুনে উনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানালেন। বললেন, গার্মেন্টস উদ্যোক্তাদের অবদান অনস্বীকার্য কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে মূল অবদান হলো শ্রমিকদের। কিন্তু শ্রমিকেরা ন্যায্য পাওনা পায় না, অবহেলা ও বঞ্চনার বাইরে বেরিয়ে এসে সুন্দর জীবন যাপনও করতে পারে না। অধ্যাপক সাহেব আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পিছনে এককভাবে গার্মেন্টস রপ্তানি এবং রেমিটেন্স আয়কে বাহবা দিতে রাজী নন। তিনি বললেন এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ভুল নয়, এটা বিপজ্জনক। যেমন, বাংলাদেশের কৃষকরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যদি চাল ডাল, আলু পটল, টমেটো করলা, আম লিচু উৎপাদন না করে, জেলেরা মাছ না ধরে তাহলে বিদেশ থেকে কোটি কোটি টন খাদ্যপণ্য কিনে আনতে হবে। সেই আমদানির বিল দেওয়ার সময় রেমিটেন্স আয় এবং পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয় কুলিয়ে উঠবে না। সুতরাং দেশের মধ্যে যে সব উৎপাদনকারী শ্রমিক, কৃষক, মজুর, ধোপা নাপিত, সেবা খাতে কাজ করা লোকজন কঠোর পরিশ্রম করে পণ্যসামগ্রীর যোগান দেয় তাদের অবদানকে অস্বীকার করে শুধু প্রবাসীদেরকে বাহবা দেওয়ার কোন সুযোগ নাই। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। অসুখে বিসুখে, বিপদে আপদে, সুখে দুঃখে, করোনায় কোভিডে সবক্ষেত্রে এই মানুষগুলোকে সবার আগে উৎসাহ ও প্রণোদনা দেওয়া উচিত। এদের অবদানের স্বীকৃতি থাকা উচিত। গরীব বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। উল্টোদিক থেকে দেওয়া অধ্যাপকের এই যুক্তি আমি কিছুতেই নাকোচ করতে পারলাম না।
আমি তাকে বললাম আমাদের দেশে প্রবাসীদের কদর অনেক বেশি। আপনি যত কথাই বলুন প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে এলে তাদের পরিবারের কাছে এবং আত্মীয় স্বজনের কাছে সুপারস্টারের মর্যাদা পায়। অধ্যাপক বললেন আমাদের দেশ থেকে যারা অদক্ষ অবস্থায় শ্রমিকের কাজ করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে যায়, তারা তাদের আয়ের পুরো অংশটাই দেশে পাঠিয়ে দেয়। এরাই আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহকে গতিময় করে রাখে। এইসব গৃহকর্মী, অদক্ষ শ্রমিকদের আমরা তেমন দাম দিই না। যারা বড়ো বড়ো ডিগ্রিধারী, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় বড়ো বড়ো চাকরি করেন তারা দেশে কি পরিমাণ টাকা পাঠায় তা কখনো ভেবে দেখেছেন? অনেকেই তো দেশের জমি জমা বিক্রি করে বিদেশে টাকা নিয়ে যায়। আবার অনেক আমদানীকারক ওভার ইনভয়েসিংয়ের আড়ালে দেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে দেয়। সুতরাং রেমিটেন্স আয়ের বিষয়টিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। ভারতের কেরালা রাজ্যের অনেক হাউসমেইড মধ্যপ্রাচ্য এবং আরবে চাকুরি করে। তারা খুবই দক্ষ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের আয়ের বদৌলতে কেরালা ভারতের একটি অর্থনৈতিক শান্তির রাজ্য। অধ্যাপক সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আপনাকে আমার তরুণ বয়সের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলবো? আমি আমার শ্বশুরদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেদিন উনাদের ভাইয়ের এক দুবাইওয়ালা জামাতা দুবাই থেকে ফিরেছেন। উনাদের বাড়ি আসার সময় সে শালা শালীদের জন্য একটি আশ্চর্য গিফট এনেছিল। সেটি হলো একটা টেলিভিশন সেটের সাথে টেপ রেকর্ডার এবং রেডিও যুক্ত ছিল। যাকে বলা হয় ত্রি ইন ওয়ান। এখন থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগের জন্য ঐ যন্ত্রটি খুবই আশ্চর্য বিষয় ছিল। ওটা দেখে আমিও অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্ত্রীর চাচাতো বোনের ঐ দুবাইওয়ালা স্বামী এ আশ্চর্য যন্ত্রটি নিয়ে আসার পর সে বাড়িতে জামাই হিসেবে তার কদর যতটুকু উপরে উঠেছিল আমার কদর তার চাইতেও অনেক বেশি নীচে নেমে গিয়ে তলানীতে ঠেকেছিল। এই কথা শুনে আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বড়ো? নাকি দুবাইওয়ালা বড়ো?
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিষ্ঠাবান এক গবেষকের বিদায়
পরবর্তী নিবন্ধনগরে আরো ৫স্পটে করোনা বুথ স্থাপন