বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ২৬ জুন, ২০২৩ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

মানুষের সৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি

মানুষকেই শেষ করে দেবে

ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনকারীদের যে অগ্রগতি এবং স্বাধীনতার স্পৃহা, তা খুবই উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় ছিল। তখনকার তরুণ সমাজ বাঙালি জাতীয়তাবাদে আগ্রহী হয়েছিল এবং নতুন রাষ্ট্রচিন্তায় তারা বিভোর ছিল। পরবর্তীকালে ৭০ দশকের শুরুতেই ছাত্র জনতার দুঃসাহস চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সেদিনের তরুণ প্রজন্মের স্লোগান ছিল ‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।”। দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তরুণ প্রজন্ম অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। তারপর শুরু হয় নতুন এক যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি মেলেনি। মানুষ নানা রকম দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। যেমন বলা হয় মানুষ অভ্যাসের দাস। মানুষের কিছু কিছু অভ্যাস আছে, যে অভ্যাস তাকে দাসে পরিণত করে। যে মানুষ ধূমপানে আসক্ত হয় বা অভ্যস্ত হয় সে বিড়ি সিগারেটের দাসে পরিণত হয়। যে মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয় বা অভ্যস্ত হয়, সে মাদকের দাসে পরিণত হয়।

এ দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। সারা পৃথিবীব্যাপী প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। পঞ্চাশের দশকের আগে প্রযুক্তির অগ্রগতি ছিল ধীরগতি সম্পন্ন। ১৯১৬ সালে চার্লস ব্যাবেজ প্রথম কম্পিউটার আবিষ্কার করেন। সেটি ছিল একটি বিশাল আকৃতির কম্পিউটার। মাইক্রো চিপসের আবিষ্কারের পর কম্পিউটারের আয়তন ছোট হতে থাকে। পরবর্তীতে তা ডেস্কটপে এসে দাঁড়ায়। তারপর ল্যাপটপ এবং বর্তমানে অনেক মিনি আকৃতির আইসিটি ডিভাইস মানুষ ব্যবহার করে। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারের কারণে মানুষ এখন মোবাইল ফোনের মধ্যে অথবা ট্যাবলয়েড আকারে ইন্টারনেটের সকল সুবিধা ব্যবহার করতে পারে।

টরেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর ডক্টর মার্শাল ম্যাকলুহান্স ‘দি মিডিয়া ইজ দি মেসেজ’ নামে একটি বই লেখেন। তিনি ছিলেন ভাষা ও কমিউনিকেশন বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি বলেছিলেন, প্রিন্ট মিডিয়া মানুষের ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। বরং ছাপা মাধ্যম মানুষের অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে -It is curse for humanity.

ম্যাকলুহান্স ফেস টু ফেস মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক অসন্তোষ, রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ-ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের ক্ষেত্রে প্রিন্ট মিডিয়া তেমন ভূমিকা পালন করতে পারে না। আমাদের অতি দ্রুত ফেস টু ফেস মিডিয়ায় যেতে হবে। কিন্তু তখন ফেস টু ফেস মিডিয়ার কথা মানুষ চিন্তাও করতে পারত না। এটি ছিল অলীক স্বপ্ন। তিনি বলেছিলেন, যখন আমরা যোগাযোগ করি, তখন শুধু ভাষার মাধ্যমে পুরোপুরি যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। আমাদের চারপাশে যে পরিবেশ থাকে আমাদের চেয়ার, টেবিল, কক্ষ-সজ্জা সবকিছু যোগাযোগের অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করে। সুতরাং প্রিন্ট মিডিয়ার পরিবর্তে মানুষকে ফেস টু ফেস মিডিয়ার দিকে যেতে হবে। এই অকল্পনীয় চিন্তাভাবনা প্রকাশিত হওয়ার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ডক্টর ফ্রাই বলেছিলেন মার্শাল ম্যাকলুহান্স একজন পাগল।

কিন্তু মাত্র এক দশকের মধ্যেই আইসিটির ক্ষেত্রে অকল্পনীয় উদ্ভাবন আসতে থাকে। মাইক্রো চিপসের উন্নয়নের ফলে মানুষ ফেস টু ফেস মিডিয়াতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তারপর টেলিভিশন থেকে ইন্টারনেটের লক্ষ্যে পৌঁছাতে মানুষকে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি। ১৯৬৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ম্যাকলুহান্স মারা যান। আজ আমরা ফেস টু ফেস মিডিয়ার চরম উৎকর্ষের স্থানে পৌঁছে গেছি। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আমরা অনেক অসাধ্য কাজ সফল করছি। মহাকাশ গবেষণা, ঔষধ এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণা, কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণা, যুদ্ধবিজ্ঞানের উন্নয়নে, জৈব রসায়নের উন্নয়নের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশাল ভূমিকা পালন করছে।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। মানুষের গাড়ি- ঘোড়া, যানবাহন, বিমান সবকিছুর পরিচালনা পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। এই অবস্থা দেখার পর ম্যাকলুহান্সকে পুনরায় মূল্যায়ন করার সময় যখন উপস্থিত হয়, তখন বিশ্লেষকেরা মতামত দিতে শুরু করেন, ম্যাকলুহান্স হ্যাজ বর্ন ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স বিফোর হিজ বার্থ। পরবর্তীকালে ডক্টর ফ্রাইও একই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। এখন ম্যাকলুহান্সকে ‘মিডিয়া প্রফেট’ বলে অভিহিত করা হয়। তার এই বক্তব্যের কারণে গ্লোবাল ভিলেজ ধারণার সৃষ্টি হয়।

চায়না মিরাকল নামে একটি প্রবাদ বাক্য পশ্চিমাদেশ সমূহে প্রচলিত আছে। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চীনা জাতির উত্থানের পর এত কম সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীন কিভাবে উন্নয়নের চমক সৃষ্টি করল? ১৯৮০’র দশকের মধ্যভাগে চীনে দেঙ শিয়াও পিং চীনের ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় তার সরকারকে ছয়টি প্রযুক্তি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল জৈব প্রযুক্তি, জিনোম সিকোয়েন্সিং, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সহ অন্যান্য লাগসই প্রযুক্তি। তার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছিল তথ্যপ্রযুক্তি। বর্তমানে চীন প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এত উন্নতি সাধন করছে যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে পশ্চিমা দেশগুলিকে টপকিয়ে গেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়না মিরাকল নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তিত। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে, বিশ্বের সামরিক প্রাধান্যের ক্ষেত্রে, প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে চীনকে পেছনে ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়। এক মেরুর বিশ্ব এখন বহু মেরুর বিশ্বে পরিণত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণে ডলারের আধিপত্য কমে যাচ্ছে। এইসব পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়ন। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রেও চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

প্রযুক্তির এত প্রশংসা সত্ত্বেও চিন্তার একটি বিষয় রয়েছে। সেটি হল শিশু কিশোর এবং তরুণ সম্প্রদায় প্রযুক্তির দাসে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির দাসত্ব থেকে তাদের মুক্ত করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। প্রযুক্তি দিচ্ছে যোগাযোগের অবারিত সুযোগ। কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে তাদের স্বাধীন চিন্তা শক্তি। প্রযুক্তির এই দাসত্ব সারা বিশ্বের নব প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটি একটি চিন্তার বিষয়। এই বিষয়ে পৃথিবীর সকল দেশের শিক্ষাবিদগণ চিন্তায় পড়ে গেছে। অতীতে রাজা-মহারাজা বা সম্রাটদের দাসত্ব গ্রহণ করে মানুষ মানবতা হারাতো। মানবাধিকারও হারাতো। রাজতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাকে আমরা মানবতার শত্রু মনে করি। কিন্তু প্রযুক্তির দাসত্ব গ্রহণ করার পর, যারা দাসত্ব গ্রহণ করে তারা আনন্দিত হয়। দাসত্বের সাথে আনন্দের এই সংমিশ্রণ মানুষের জন্য একটি চিন্তার বিষয়। এটা মানুষ আনন্দের সাথে গ্রহণ করে।

উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শাসক শ্রেণি উন্নয়নের অনেক গল্প তৈরি করে। কিন্তু উন্নয়ন ধারণার মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে সেটি তারা স্বীকার করে না। উন্নয়নের কারণে পরিবেশ ধ্বংস হয়, বৃক্ষ নিধন হয়, নদী দখল হয়, জলাধার ভরাট হয়ে যায়। এই কাজগুলিও মানুষ আনন্দের সাথে করে। মানুষের মানবাধিকার এবং মানসিক শান্তি রক্ষা করার জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। প্রথমত আমাদের শিশু-কিশোরদের রক্ষা করার জন্য শিক্ষা পদ্ধতিতে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তারা যাতে চিন্তার দিক থেকে স্বাবলম্বী হতে পারে সেই ধরনের শিক্ষা দিতে হবে। শিশুরা যাতে পরিপূর্ণভাবে ইন্টারনেটের দাসে পরিণত না হয় সেটা চিন্তাভাবনা করার এখন সঠিক সময়।

পৃথিবী এমনিতেই যুদ্ধবিগ্রহের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমন সূক্ষ্ম অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে যা আগে কখনো কল্পনা করা হয়নি। তার উপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনী সুর শোনা যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জন্য বড় কোনো বিপর্যয় ডেকে আনছে কিনা সেটাও একটি ভাবার বিষয়।

৬০’এর দশকে আমরা যখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখন ইন্টারনেট, মোবাইল, টেলিফোন কিছুই ছিল না। আমরা কেবল বই পড়তাম। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরী ছিল এবং দুই আনা দিয়ে বই ভাড়া পাওয়া যেত। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষে অনেক বই আসতো। আমি ছাত্র অবস্থায় ম্যাক্সিম গোর্কি, আন্থন চেখভ, দস্তয় ভস্কি সহ অনেক সোভিয়েত লেখকের বই পড়ে ফেলেছি। আমার নামে মস্কো থেকে প্রগতি প্রকাশন বিনা পয়সায় বই পাঠাতো। তাদের পাঠানো একটি সায়েন্স ফিকশন বই আমার হাতে আসে। এক সোভিয়েত বিজ্ঞানী রোবট বানানো চেষ্টা করছে। যেদিন রোবট তৈরি হয় সেদিন বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেন যে, রোবটটি একটি ছুরি হাতে তার সৃষ্টিকর্তার দিকে এগিয়ে আসছে। বিজ্ঞানী খাটের তলায় লুকিয়ে পড়েন। রোবট তাকে খাটের তলায় আঘাত করার জন্য এগিয়ে যায়। বিজ্ঞানী সেখান থেকে বের হয়ে দৌড়াতে শুরু করেন। রোবট থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু রোবট কিছুতেই তাকে পিছু ছাড়ছে না। অবশেষে বিজ্ঞানী একটি চলন্ত গাড়িতে উঠে পড়েন। তখন তিনি লক্ষ্য করেন যে পিছনের গাড়িতে রোবট উঠে পড়েছেন তিনি মৃত্যু ভয়ে কাতার হয়ে পড়েন। হঠাৎ তার গাড়ির ড্রাইভার ব্রেক কষে গাড়ি থামায়। তখনই বিজ্ঞানের মাথায় একটা চিন্তা আসে, তিনি ভাবতে শুরু করলেন কেন আমি রোবটের মধ্যে ব্রেক স্থাপন করলাম না। যাতে সময় মতো থাকে থামানো যায়। আজ মানুষের উদ্ভাবিত উন্নততর তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে এমন ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে, যাতে তাকে প্রয়োজনমতো থামানো যায়। না হলে মানুষের সৃষ্ট প্রযুক্তি একদিন মানুষকেই গ্রাস করবে।

লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম; শিক্ষাবিদ, কলাম লেখক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক টাকা আদায়ে মামলা দায়েরের সময়সীমা প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধযৌন হয়রানিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন ও কর্মস্থল