বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি কয়েকটি বিষয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। প্রথম দুশ্চিন্তার বিষয় হলো মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে অস্থিতিশীলতা। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের কোনো রকম সংঘাত নেই। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্তিতিশীলতা বাংলাদেশ সীমান্তে একটি বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। গত কয়েকদিন ধরে বান্দরবান, উখিয়া, টেকনাফ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সেনাবাহিনীর সাথে এবং তাদের বর্ডার পুলিশের সাথে আরাকান আর্মির সরাসরি সংঘর্ষের কুফল ভোগ করছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার গ্রামবাসী এবং সাধারণ জনগণ। আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশের সংঘর্ষের জেরে এবং হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া রকেট শেলের অবশিষ্ট অংশ এসে পড়ছে এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশের দুইজন নাগরিক নিহত ও আরো কয়েকজন আহত হয়েছে। মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশের তিনশতাধিক সদস্য এবং আরো অন্যান্য ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। তাদের নিরস্ত্র করে বাংলাদেশ বর্ডারগার্ড তাদের আশ্রয়ে রেখেছে এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ এই ব্যাপারে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ঢাকায় ডেকে এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। এগার লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী গত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের খাবার বাসস্থানের বোঝা বহন করতে করতে বাংলাদেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আরো নানাদিক থেকে এই শরণার্থীদের তরফ থেকে নিরাপত্তার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিষয়ে আমরা চিন্তিত। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিবে সেটা শুধু বাংলাদেশের সরকারের ইচ্ছার সাথে নির্ভর করে না। এর সাথে ভূ–রাজনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আরো একটি বিষয় নিয়ে আমি দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। সেটা হলো মধ্য প্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং এই অঞ্চলে যুদ্ধ বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজা এবং পশ্চিম তীরের ইজরায়েলের অমানবিক হামলা এবং হামাস নির্মূলের নামে পরিচালিত যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের অকথ্য নির্যাতনের চিত্র গণমাধ্যমে নিত্যদিন প্রকাশিত হচ্ছে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের হামলা চলছে। হুতি বিদ্রোহীদের লোহিত সাগরে জাহাজে হামলাকে কেন্দ্র করে ইয়ামেন ও লেবাননে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার জোটভুক্ত দেশগুলোর আক্রমণের খবর আমরা জানতে পারছি। সিরিয়া এবং জর্ডান সীমান্তে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের আক্রমণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে সংঘাত বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নৌপথে চলাচল কারী জাহাজের চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে এবং তার জেরে বাংলাদেশে আমদানি রপ্তানিকৃত পণ্যের পরিবহনের খরচের উপরে প্রভাব এসে পড়তে পারে। এই ক্ষেত্রে গাজায় মানবিক বির্যয় যেমন দুঃখজনক ব্যাপার তেমনি মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমাদের সংঘাতের কারণে সারা বিশ্বের উন্নত এবং অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি প্রভাবিত হতে পারে এবং জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হয় এই বিষয় নিয়ে বিশ্ববাসী উদ্বেগের মধ্যে আছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের তুলনায় ভালো এবং এটি স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে এসেেছ। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। বাংলাদেশে অবকাঠামোগত এবং ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে উন্নত হয়েছে, মানুষের গড় বার্ষিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং প্রবাসী আয়ও বেড়েছে। অর্থনীতিবিদগণ এই সমস্ত বিষয় স্বীকার করেন। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিবাদ ছিলো তাও স্তিমিত হয়ে এসছে। পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশের নির্বাচনকে সমর্থন করেছে যার মধ্যে রাশিয়া, ভারত ও চীনের কথা উল্লেখ করা যায়। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন তাদের জোটে থাকা পশ্চিমা কিছু দেশ বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে তাদের আপত্তি প্রকাশ করেছে। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং অনুসারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে একত্রে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন এবং একসাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি আন্দোলন করেছিলো কিন্তু তার মধ্যে আওয়ামী লীগ সঠিকভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে এবং তারা সরকার গঠন করে তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বিএনপি আন্দোলনের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পাবে কিনা এসব বিষয়ে নানা রকমের ধোঁয়াশা তৈরী হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের এই বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং আজকে একটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে পরিণত হতে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে টানা চতুর্থবার এবং সর্বমোট পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ পরিচালনা করার সুযোগ পেয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে এবং বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের কাছ থেকে শেখ হাসিনা প্রশংসায় ভাসছেন। এবং তিনি যদি সঠিকভাবে দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারেন, সুশাসন কায়েম করতে পারেন, দুর্নীতি রোধ করতে পারেন এবং আর্থিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারেন, অর্থ পাচার খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তখন তার সাফল্যের ধারা আরো জোরদার ভাবে সামনে এগিয়ে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ যা নিয়ে আমরা চিন্তার মধ্যে আছি সেটি হলো খাদ্যদ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। দেশের জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশ দরিদ্র অবস্থার মধ্যে আছে, তাদের মধ্যে বেকারত্ব আছে এবং তাদের যে আয় রোজগার হয় তা দিয়ে বর্ধিত মূল্যে খাদ্যদ্রব্য কেনা, ওষুধপত্র কেনা তাদের জন্য খুবই কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য কেন বাড়ে এবং কিভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে বিষয়ে কোনো না কোনো পদ্ধতি বের করা অত্যন্ত জরুরি। অনেকেই বলছেন খাদ্যদ্রব্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার তদারকি করে সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যে সমস্ত সিন্ডিকেট বাজারে কাজ করে তাদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। খাবার ওষুধপত্র যদি মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি আরো অনেকগুণ বেড়ে যেতে পারে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ কি সিন্ডিকেট? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। এর সদুত্তর পাওয়া একান্ত প্রয়োজন। আমাদের গণমাধ্যম বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখিয়েছে কৃষি ক্ষেত্রে যে মূল্যে চাষীরা তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রি করে সেটি উৎপাদনের স্থল থেকে শহরে খুচরা বাজারে অনেক গুণ বেড়ে যায়। এ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? সিন্ডিকেটের কারসাজি নাকি অন্যকিছু। আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন আমার মার্কেটিং সাবজেক্ট ছিলো। তখন একটি প্রশ্ন আমাদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে হতো। প্রশ্নটি হলো –কৃষি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে বাজার থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্র্মূল করা যায় কীভাবে এই বিষয়ে লেখাপড়া করতে করতে আমি খেই হারিয়ে ফেলতাম কীভাবে মধ্যস্বত্বভোগীকে কৃষি পণ্যের বাজার ব্যবস্থা থেকে নির্মূল করা যায়। আসলে আমি কখনো এর কোনো সমাধান বের করতে পারিনি। কারণ মধ্যস্বত্ব ভোগীরা বিপণন ব্যবস্থায় থাকবে এবং কৃষি পণ্যের বাজার থেকে তাদের নির্মূল করা কঠিন ব্যাপার।
বর্তমানে যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে তারাও একধরনের মধ্যস্বত্বভোগী তারা বিপণন চ্যানেলের মধ্যখানে এসে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে। যদি আমরা উৎপাদক ভোক্তার মধ্যে সরাসরি বিপণন চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম তাহলে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন মূল্য এবং বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ফারাক কম হতো। কিন্তু সেটি কখনো সম্ভব নয় কারণ কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে খুচরা ব্যবসায়ী পাইকার দালাল এদের উপস্থিতি থাকে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের দাম বেড়ে যায় তাতে পরিবহন খরচ যুক্ত হয়, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন রকমের বাড়তি খরচ যুক্ত হয়। এর ফলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। সুতরাং শুধু বাজার তদারকি করে পণ্যের দাম কমানো যাবে এটা আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় যে সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যে কোনো না কোনো পরিবর্তন আনতে হবে। উৎপাদনকারী কৃষকের কাছ থেকে পণ্য সরবরাহ চ্যানেলে যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে ব্যবস্থা করতে পারলে জিনিসের মূল্য স্থিতিশীল হবে। অতীতে আমরা যদি দেখি তাহলে দেখা যায় যে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা না থাকার কারণে এক অঞ্চলের পণ্য আর এক অঞ্চলে যেতে পারত না। ফলে কোনো অঞ্চলের একটি কৃষি পণ্য কম দামে বিক্রি হলে অন্য অঞ্চলে সেটি বেশি দামে বিক্রি হত। কিন্তু বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত সুষ্ঠু হওয়ার কারণে ঘাটতির এলাকায় উদ্বৃত্তের এলাকা থেকে পণ্য চলে আসে। এই কারণে পণ্যের চলাচল সহজতর হয় বলে বিপণন ব্যবস্থায় পাইকারী খুচরা এবং অনান্য মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট বেড়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। একটি সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থাপনায় কেবল পণ্যের দাম স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে। কেবল তদারকির মাধ্যমে বা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে এই কাজ করা সম্ভব নয়। আমরা যদি আমাদের পণ্য বিপণন ব্যবস্থায় একটি যথাযথ পরিবর্তন আনতে পারি এবং খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পারি, সরকারের জন্য, জনগণের জন্য এবং দেশের জন্য এই সাফল্য আমাদের উন্নয়নের যাত্রায় একটি নতুন মাইলফলক স্থাপন করতে সক্ষম হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ; প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজ।