বাংলাদেশের রাজনীতি হরতাল অবরোধে টালমাটাল অবস্থা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের জোয়ারের একটি ধাক্কা লেগেছে। ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন স্থাপিত রেল লাইন উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কক্সবাজারে একটি আইকনিক রেল স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের সকল রেল স্টেশনের চাইতে উন্নতমানের। পর্যটন শহর কক্সবাজারে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপন করা হয়েছে। মহেশখালীতে ১১ নভেম্বর গভীর সমুদ্রবন্দর উদ্বোধন সহ আরও ১৪টি প্রকল্প, বিশেষ করে কক্সবাজার–চট্টগ্রাম মধ্যবর্তী বাঁকখালী নদীর ওপর পাঁচশ মিটার লম্বা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। তার আগে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা অঞ্চলে একটি টানেল নির্মাণ করা হয়েছে যাকে এশিয়া মহাদেশের সর্বাধুনিক টানেল বলা হচ্ছে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম, এবং মহেশখালী গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চল পর্যন্ত বিরাট আকারের শিল্প কারখানা স্থাপিত হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতিবিরা এ রকমই আশা করছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর এই উন্নয়ন প্রকল্প গোটা দেশকে উন্নয়নের এক নতুন মাত্রা উপহার দিয়েছে। রাজনৈতিক এ টালমাটাল অবস্থার মধ্যেও সরকারের এই সকল সাফল্য জনসাধারণের মনে রেখাপাত করবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগণ সেটাই মনে করেন। হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করে যে সকল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলো তা অবশ্যই অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনবে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলির পেছনে বিশাল অঙ্কের ঋণ বহুদিন ধরে পরিশোধ করে যেতে হবে। সুতরাং এই প্রকল্প সমূহ ভবিষ্যতে সঠিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে কি না সেটি বিরাট একটি প্রশ্ন হিসাবে আমাদের সামনে দেখা দেবে। যদি প্রকল্পগুলি সঠিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত না হয় তাহলে এই প্রকল্পগুলির ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে। এইজন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সু–শাসনের প্রয়োজন রয়েছে। এইজন্য দক্ষ জনবল এবং সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে, সঠিক মানুষকে দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায় পদ্মা সেতুর মতো, মেট্রো রেলের মতো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের সময় আমাদের দেশেও ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তির সক্ষমতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং জনবলের কর্মতৎপরতা সফলভাবে এবং সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করা হয়। এতে সময় এবং অর্থ দুটি সাশ্রয় হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলি অব্যাহত রাখার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা একান্ত প্রয়োজন। বিভিন্ন উন্নত দেশে উন্নয়ন ধারণা বা ডেভেলপমেন্ট কনসেপ্ট এর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভোটের মাধ্যমে সরকার অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের পছন্দ অনুসারে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তারা তাদের দূরদৃষ্টি, ভবিষ্যৎমুখী চিন্তা দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং প্রবৃত্তিগতভাবে দক্ষ ব্যক্তিত্বদের আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ব্যক্তিত্বদের অবদানের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহাশূন্যে স্যাটেলাইট প্রেরণ, পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সমপ্রসারণের ক্ষেত্রে। এই সকল প্রকল্প সঠিকভাবে পরিচালিত করা যাবে কি না সেটা সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে। নতুন নতুন ধারণায় যেটা বলা হচ্ছে তা হলো উন্নয়নের দুটি দিক আছে; একটাকে বলা হয় সাপ্লাই সাইড অন্যটাকে ডিমান্ড সাইড। যখন ব্যবসা বাণিজ্য বেড়ে যাবে, তখন যোগাযোগ ও চাহিদার সৃষ্টি হবে। ফলে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, নৌ এবং বিমানবন্দর নির্মাণের ও উন্নয়ন কাজের দরকার হবে। যখন মানুষের খাদ্যের চাহিদা বাড়বে, তখন আধুনিক কৃষি এবং উৎপাদনের প্রয়োজন হবে। যখন বিদেশে পোশাক, চামড়া অন্যান্য পণ্য রফতানি হবে তখন দেশে গার্মেন্টস শিল্প, চামড়া শিল্প ও অন্যান্য শিল্প কারখানার প্রসার ঘটবে।
এখন থেকে একশ বছর আগে রাস্তাঘাট, শিল্প কারখানা নির্মিত হয়নি, প্রযুক্তি সমপ্রসারিত হয়নি, কারণ তখন চাহিদা সৃষ্টি হয়নি। উন্নয়নের সাপ্লাই সাইড হল ব্রিজ, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র এসব নির্মাণ করা। কিন্তু তার চাহিদা দিক বা ডিমান্ড সাইড হচ্ছে দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে বিশাল বাজার ও বড় আকারের চাহিদা সৃষ্টি করা এবং কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের জনসংখ্যা যত বাড়ছে ততই আমাদের চাহিদা বেড়েছে। সেজন্য আমাদের শিল্প কারখানা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নেরও প্রয়োজন বেড়ে গেছে। তাই উৎপাদন এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে উন্নয়নের গতি আরও অনেক বেড়ে যাবে যখন প্রযুক্তির চাহিদা বাড়বে। যেমন জনগণের মধ্যে মোবাইল ফোনের চাহিদা যখন বাড়বে তখন মোবাইল কোম্পানির ব্যবসাও বাড়বে, মোবাইল সেট এর সরবরাহ বাড়বে, কল কারখানার উৎপাদনও বাড়বে। সুতরাং জনগণের চাহিদা অর্থাৎ মার্কেটিং এর সাথে উন্নয়নের একটি সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান সরকার এই চাহিদা এবং সরবরাহের দিক গুলোর মধ্যে দক্ষতার সাথে সমন্বয় স্থাপন করতে পেরেছে। কিন্তু যদি দক্ষ প্রশাসন, দক্ষ ব্যবস্থাপনা বহাল না থাকে জনগণের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের মধ্যে যদি তখন আস্থা বিরাজ না করে তাহলে এই সকল সুফল ব্যবহার করা কষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সফল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি অত্যাধুনিক চিন্তা বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞগণ প্রকাশ করছেন। সেটি হল, আগে মনে করা হত যে কোম্পানির উদ্যোক্তা এবং মালিকগণ শ্রমিকদের বিভিন্ন উপকরণের জোগান দিয়ে থাকেন এবং শ্রমিকদের বেতন দিয়ে উৎপাদন কার্য সম্পন্ন করেন। কিন্তু আধুনিক ব্যবস্থাপনার যে পরিবর্তন ঘটেছে সেখানে বলা হচ্ছে প্রশাসন অথবা ব্যবস্থাপনা, শ্রমিকের শ্রম সম্পর্কিত কাজ কর্মের পর্যবেক্ষণের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। Management is concern with work done by the worker. মানুষের শ্রম এবং পশুর শ্রমের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। মানুষের শ্রম অত্যন্ত গতিশীল। পশুর শ্রম একেবারেই স্থির। মানুষ আজ যেভাবে কাজ করছে আগামীকাল তার চাইতে অনেক উন্নত ধারায় সে কাজ করবে। ৫০ বছর আগে মানুষ যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত এখন তার চাইতে অনেক উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। মানুষের কাজে শ্রমের অঙ্গভঙ্গি, ভাবনা সব কিছু পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেমন গরু ঘাস খায়, ১০০০ বছর ধরে গরু একইভাবে ঘাস খায়। কিন্তু মানুষের খাবারের পদ্ধতি, রান্নার পদ্ধতি, খাবারের কক্ষ, ডাইনিং টেবিল সব কিছুতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়েছে। যারা কারখানার শ্রমিকদের ওপর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন, তাদের কাজ হল দুটি; একটি হচ্ছে শ্রমিকের কাজের সময় সকল উপকরণের জোগান দেওয়া এবং আর একটি দায়িত্ব হল শ্রমিক কাজ করার পরে তার মধ্যে যে উৎকর্ষতা বা excellence তৈরি হয়, সেই উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী উৎপাদনের ধরন পাল্টে দেওয়া। এই কারণে গাড়ির মডেল পরিবর্তন হয়, বিল্ডিংয়ের সৌন্দর্য্য বাড়ে, প্রত্যেক পণ্য সামগ্রীর মধ্যে নতুন নতুন উৎকর্ষতা যুক্ত হয়। বাংলাদেশের প্রশাসক বা ব্যবস্থাপকগণ যদি উৎপাদনের এবং উন্নয়নের এই ধারণাটি বুঝতে না পারেন তাহলে উন্নয়নের পেছনে আমাদের বিশাল বিনিয়োগের কোনও অর্থ থাকবে না। সেজন্য উন্নয়নের গতি যত বৃদ্ধি পাবে ততই এক উন্নততর দক্ষ মানবসম্পদ তৈরী করতে হবে। উদ্ভাবকদের কাজের সুযোগ দিতে হবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
শ্রমিকদের শ্রম কেবলমাত্র সব সময়ের জন্য শ্রম উৎকর্ষতার কাজে ব্যবহার করতে হবে এবং জীবনযাত্রা পরিচালনার জন্য তাদের যে টাকার প্রয়োজন, বাজারের সাথে এবং দ্রব্যমূল্যর সাথে সঙ্গতি রেখে তাদের সেই টাকা দিতে হবে। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ এক একটি বিরাট বাজারের নিয়ামক শক্তি। এই বাজারে বাংলাদেশের এবং বিদেশেরও অনেক পণ্য ভোক্তারা ব্যবহার করেন। অনেকে মনে করেন যে ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপরে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। আমার মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ যদি বিদেশের কোম্পানিগুলির পণ্য বর্জন করে সেই কোম্পানিগুলি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন কোকাকোলা, পেপসির মতো পণ্য মানুষ যদি না কিনে, নেসলের পণ্য যদি না কিনে তাহলে সেই কোম্পানিগুলি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সুতরাং বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশকে বিদেশিরা অনেক সময় গুরুত্ব দেয় শুধুমাত্র ডিমান্ড সাইটের জন্য অর্থাৎ বিশাল বাজারের জন্য।
বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি কোনও বিশেষ দলের বা কোন বিশেষ রাজনৈতিক শক্তির ইচ্ছায় চলে না। বরং সেটি জনগণের মধ্যে চাহিদা থাকায় তৈরী হয় এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও জনগণের চাহিদার কারণে সম্পন্ন হয়। কোন সরকার ইচ্ছা করলে কোন দেশকে ডিজিটাল দেশ বা স্মার্ট বানাতে পারে না। বরং সারা বিশ্বে প্রযুক্তির যখন প্রসার ঘটে তার ঢেউ বাংলাদেশেও আসবে এবং বাংলাদেশের জনগণ যদি সেই প্রযুক্তি তাদের চাহিদার মধ্যে নিয়ে আসে তাহলে কেউ বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না, সে প্রযুক্তির প্রসার ঘটবে। মাদকের চাহিদার কারণে সরকার বাধা দেয়ার চেষ্টা করা সত্ত্বেও মাদকের বিস্তার ঘটে। তামাকের বিস্তার ঘটে। সুতরাং সারা বিশ্বে প্রবাহমান উন্নয়নের যে ধারা, সেই ধারা থেকে কোনও দেশ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বাংলাদেশের এই উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আরও একটি বিষয় বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। আশা করি সরকার এই বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে। সেটি হল রাজনৈতিক হানাহানি, বিদ্বেষ এবং বড় শক্তিগুলির মধ্যে বিভেদ উন্নয়নের গতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশে একটি খুবই ভাল এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার। নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ দরকার। বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল এবং সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে এটা বুঝতে হবে যে তারা পরস্পর বিরোধী যে অবস্থানে আছে, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা না করতে পারলে বাংলাদেশের সকল অর্জন বরবাদ হয়ে যেতে পারে। হায় বাংলাদেশ! তুমি উন্নয়নে সফল কিন্তু রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ।
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ; শিক্ষাবিদ, কলাম লেখক।