বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ১৫ জুলাই, ২০২৪ at ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম শহরে দক্ষিণপশ্চিম অংশ সাগরের সৈকত এবং বেলাভূমি জুড়ে বিশাল একটি অঞ্চলের নাম হালিশহর। এই হালিশহরে আমার জন্ম ১৯৪৯ সালে। এক সময় পতেঙ্গা থেকে কাট্টতলী এবং পূর্বে তৎকালীন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রোড, বর্তমান শেখ মুজিব রোড, মুনছুরাবাদ পর্যন্ত এলাকাকে আমরা আমাদের হালিশহর অঞ্চল মনে করতাম। পরবর্তীকালে এই হালিশহর ছোট হতে হতে অনেক অংশে বিভক্ত হয়ে তার পূর্ব পরিচয় বা আসল চেহারা হারিয়ে ফেলেছে। দক্ষিণে পতেঙ্গা কর্ণফুলীর মোহনা থেকে উত্তরে কাট্টলী পর্যন্ত পুরো এলাকাটি একটি গ্রাম হিসেবে বিবেচিত হত। এটি চট্টগ্রাম মিউনিসিপালিটি বা পৌর এলাকার বাইরে ইউনিয়ন কাউন্সিল হিসেবে বিবেচিত হত। এই এলাকার রাস্তাঘাটে যানবাহন বিশেষ করে যান্ত্রিক গাড়ি ঘোড়ার চলাচল খুবই কম ছিল। এখানে কোনো বাস সার্ভিস বলতে কিছু ছিল না। প্রায় সবগুলো রাস্তাই কাঁচা ছিল। পাঠানটুলী, চৌমুহনী থেকে ইশান মিস্ত্রির হাট পর্যন্ত তৎকালীন জেলা বোর্ডের সড়কটিও কাঁচা ছিল। এই রাস্তায় যান্ত্রিক গাড়ি ঘোড়া যেমন: বেবী টেক্সি, ট্রাক, বাস ইত্যাদি চলাচল করত না। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও সীমিত ছিল।

আমরা দেওয়ানহাট গেলে সেই রাস্তায় ফাঁকা ফাঁকা ট্রাক, বাস দেখতে পেতাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে তখন দেওয়ানহাটের ব্রিজটিও নির্মাণ হয়নি। নিচে রেল লাইনের ওপর দিয়ে গাড়ি পার হতো। আবার শহরের প্রধান গরুর হাট ও ছিল দেওয়ানহাটে। বাস এবং ট্রাকে যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক অথবা হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবস্থা ছিল না। ট্রাকে বা বাসে খেলার মাঠে যে ধরনের ভুভুজেলা বাজানো হয় সেরকম একটা পাম্পিং যন্ত্র বসানো থাকতো। তার পেছন দিকে রাবারের একটি ব্লাডার থাকতো। সেটি ড্রাইভার চাপ দিলে ভোঁ ভোঁ শব্দ হতো এটাই ছিল গাড়ির হর্ন এবং বাস ও ট্রাকে এটাই ব্যবহৃত হতো। খুব হাতে গোনা রিক্সা রাস্তায় চলাচল করত। এই রিক্সাগুলো ছিল প্যাডেল চালিত। এখন যে বৈদ্যুতিক রিক্সা ব্যবহৃত হয় তখন সেটি কল্পনারও বাহিরে ছিল। সেই পুরোনো আমলের রিক্সায়ও এক ধরনের হাতে চাপ দেওয়া যন্ত্র হর্ন হিসাবে ব্যবহৃত হতো। একটি পাইপের পিছনে ছোট্ট একটি যন্ত্র রাবারের ব্লাডার লাগানো ছিল সেটি চাপ দিলে যে শব্দ হতো সেটাই ছিল রিক্সার হর্ন। এরকম হর্ন সাইকেলেও ব্যবহৃত হতো। তখন হালিশহরের মানুষের বড় বাহন ছিল দুই চাকার সাইকেল। রাবারের ব্লাডার চেপে হর্ন বাজানো সেই পদ্ধতি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যারা এখন মধ্যবয়সে আছেন তারাও এই গাড়ি এবং এই হর্নের ব্যাপারে বলতে পারবে না। আমাদের পুরানো অনেক কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আধুনিক পদ্ধতি, আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রযুক্তি তার স্থান দখল করেছে। যেমনঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়ি বলতে কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নাই। আমাদের এলাকায় তিন চারজন মানুষের গরুর গাড়ি ছিল।

আমাদের হালিশহরের রাস্তাঘাট পাকা হওয়ার পর গরুর গাড়িতে একটি সংস্কার আনা হয়। আমরা ছোট কালে গরুর গাড়ির যে চাকা দেখেছি কাঠের তৈরী চাকা তার প্রান্ত দেশে লোহার একটি পাত লাগানো থাকতো। সেই চাকা পরিবর্তন করে রাবারের টায়ার লাগানো হয় যাতে রাস্তা ভেঙে না যায়। আদি গরুর গাড়িগুলো মানুষের দূরের পথে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো অর্থাৎ গরুর গাড়ি যাত্রী টানতো। গ্রামের বউ ঝিরা বাপের বাড়ি গেলে আমরা গরুর গাড়ির মালিককে খবর দিতাম। তখন গরুর গাড়ির উপরে পং নামের একটি শেড লাগানো হতো এবং বউয়েরা সেই শেডের ভেতরে বসে থাকতো সেট কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। অথবা কোনো পরিবারের মানতের উদ্দেশ্যে কেউ বায়েজিদ বোস্তামী অথবা শাহ আমানত বা মোহছেন আউলিয়া মাজারে যাওয়ার নিয়ত করলে গরুর গাড়ি ব্যবহৃত হতো। মোহছেন আউলিয়া মাজারে যাওয়ার জন্য পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাট পর্যন্ত গরুর গাড়ি তারপর নৌকায় নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হতো। আবার স্থানীয় দোকানদাররা চাক্তাই থেকে দোকানের মালপত্র কিনতে যেত এবং তারা গরুর গাড়ি বোঝাই করে সেখান থেকে তাদের দোকানের মালপত্র পাঠাতো।

সন্ধ্যার পর থেকে গরুর গাড়ি আসত একটার পর একটা এবং তারা বিভিন্ন বাড়ির সামনে এসে হাঁক ডাক করে দোকানের মাল পথ নামিয়ে দিত আমাদের বিস্তীর্ণ জমিতে চাষাবাদ ছিল সেজন্য আমাদের ঘরে দশটির বেশি গরু লালন পালন করা হত। এই গরুর খাবার চাক্তাই থেকে গরুর গাড়িতে করে আনা হত। আমরা রাতে দাঁড়িয়ে থাকতাম রাস্তায় গরুর গাড়ি এলে সেখান থেকে আমরাআমাদের বস্তা বুঝে নিতাম। এখন সেই গরুর গাড়ির কোনো চিন্তাভাবনাও করা যায় না, সেটা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের পাশের ঘরের একজন আমাদের আত্মীয় তিনি ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন। তার বাড়ির সামনে আস্তাবল ছিল সেখানে ঘোড়া থাকত এবং সহিস চালিত এ ঘোড়ার গাড়িতে আমিও অনেক বার চড়েছি। আমি একবার কোলকাতায় ভিক্টোারিয়া মেমোরিয়াল থেকে গঙ্গার তীর পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভ্রমণ করেছিলাম। ঘোড়ার গাড়ি এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এখন আর চট্টগ্রামে কেউ ঘোড়ার গাড়িতে চড়েন বলে আমার মনে হয় না।

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক সামগ্রী অনেক প্রাণী এবং অনেক সামাজিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমাদের হালিশহরে গাছি নামের এক ধরনের লোক ঘোড়াফেরা করত। তারা শীতকালে অন্যান্য জেলা থেকে এখানে এসে থাকত। আমাদের এলাকায় রাস্তার পাশে পুকুরের পাড়ে খালি জায়গায় অনেক খেজুর গাছ এবং তাল গাছ আমরা দেখতাম। আমাদেরও সাতাশটি খেজুর গাছ ছিল। গাছিরা এই গাছ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তাতে শীতকালে রসের হাড়ি বসাত এবং গাছের মালিকের সাথে গাছিদের অর্ধেক অর্ধেক ভাগ ছিল। চার হাড়ি রশ তারা নামাতে পারলে গাছের মালিককে দুই হাড়ি রস দিত। আমরা বনে বাদারে ঘুরে অনেক সময় হাড়ি থেকে রস খেয়ে ফেলতাম এবং খেজুর গাছে বা তাল গাছে যে খেজুর বা তাল থাকত এসব খাওয়া আমাদের জন্য খুব সহজ একটা ব্যাপার ছিল। এখন আর গাছিখেজুর গাছ তাল গাছ বলতে কোনো গাছেরই চিহ্ন নেই। খেজুরের রসও এখন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্য কোনো জায়গা থেকে কেউ এনে বিক্রি না করলে আমাদের পক্ষে খেজুরের রস খাওয়াও সম্ভব হয় না। আমাদের বাড়ির পাশে একটি তাল গাছ খুব বিখ্যাত ছিল। সবাই বলাবলি করত যে কোর্টবিল্ডিং এর উপরে উঠলে এই তালগাছটি দেখা যায়। এখন কোর্টবিল্ডিং থেকে নয় দশহাত দূর থেকেও কিছু দেখা যাবে না কারণ অনেক উচুমানের হাইরাইজ ভবন হয়েছে। যার ফলে বিস্তীর্ণ প্রান্তর খালি জায়গা থাকার কোনো সুযোগ নাই। এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

আমাদের এলাকায় অনেক পুকুর ছিল। কিছু দূর পর পরই পুকুর। দিঘি এবং পুকুর হালিশহর পুরো ভর্তি ছিল। একবার আমি ভেবেছিলাম যে পুকুর ভরাট হয়ে গেলেও এই অঞ্চলের বড় বড় দিঘি এবং পুকুরগুলোর একটি তালিকা আমি তৈরি করবো। যাতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই পুকুরগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষেরা চোখে দেখতে না পেলেও অনন্ত তারা জানবে যে, সদ্য মহানগরে পরিণত হওয়া হালিশহরে গ্রামীণ ঐতিহ্য এক সময় ছিল। পুকুরের বহুবিধ ব্যবহার ছিল যখন বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টিপাত হত তখন পুকুরের পানি পুকুরের পাড় কাটা অংশ দিয়ে বেরিয়ে যেত। এবং যেখানে পাড় কাটা আছে সেখানে চাই নামের এক ধরনের মাছ ধরার বাঁশের একটি ফাঁদ বসিয়ে দেয়া হতো। সেখানে সারারাত মাছ ঢুকত এবং পুকুরের মালিকেরা সেই মাছ ধরে ধরে ঘরে নিয়ে আসত। আর বর্ষার সময় পুকুর থেকে কৈ, শিং, মাগুর শোল মাছ উজানে উপরের দিতে উঠে যেতএবং রাস্তাঘাটে মাছে ঢল নেমে যেত। এই উজানে উঠা মাছগুলো ধরে ধরে লোকের নিয়ে আসত। যাদের পুকুর আছে তারা তো বটেই এমনকি যাদের পুকুর নেই তারাও অবাধে প্রচুর মাছ খেতে পারতো। মাছের কোনো ঘাটতি ছিল না। সেই বিষয়টি এখন স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

উজানে মাছ উঠার ঘটনাও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত কারণ পুকুরই বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাহলে আর মাছ কোথা থেকে আসবে। এখন যেখানে সমুদ্রের রিং রোড তৈরী হচ্ছে এবং বাঁধের ওপর দিয়ে রাস্তায় গাড়ি চলাচল করবে কিংবা যেখানে বেটার্মিনাল হচ্ছে এবং নানা রকম উন্নয়নকাজ হচ্ছে সেটি সম্পূর্ণরূপে একটি সমুদ্র সৈকত ছিল। সেখানে কোনো রকম কোনো উন্নয়নের বা মানব সৃষ্ট কোনো বিষয় ছিল না। কোনো অবকাঠামো ছিল না। প্রত্যেক জমির মালিকেরা তাদের প্রান্তে সমুদ্র সৈকতে ছোট আকারের বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখত এবং সেই বাঁধের নিচে দিয়ে নল বসিয়ে পানি ঢুকাত এবং বের করত। এই পানিতে বর্ষাকালে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। আমাদের চট্টগ্রামের মানুষেরা যাকে গুইল্ডা মাছ বলে এবং আরেক ধরনের মাছ হলো চিড়িং মাছ। এই দুই রকমের মাছ ব্যাপকভাবে সেখানে পাওয়া যেত। কিছু ছোট সাইজের কোড়ালও সেখানে পাওয়া যেত। আমার মনে আছে যে আমাদের ঘরে কি পরিমাণে মাছ ধরা পড়েছে একদিনে সেটার হিসাব করা হতো আরি হিসাবে। আমরা তিন আরি চার আরি মাছ পেতাম। এক আরি বলতে ষোলো সের বুঝায়। তাহলে আপনি কল্পনা করে দেখেন যে কয়েক মণ মাছ এক রাতেই ধরা পড়ত এবং সেগুলোবিক্রিও হতো না। এগুলো কিন্ত মানুষকে বিনা পয়সায় দিতে হতো এবং উঠানে গর্ত করে, সেই মাছগুলোকে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো।

সেই সমুদ্রসেই মাছ সেই বর্ষার নোনা এবং মিষ্টি পানির মিশ্রণে জমিতে মাছের যে ঢল সবকিছু এখন বিলুপ্ত। স্বপ্নেও এখন এসমস্ত কিছু কল্পনা করার কোনো সুযোগ নাই। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন যে, তাহলে কি আমাদের হালিশহরের সমুদ্রসৈকত বঙ্গোপসাগরের যে তীর এটা কি, আমরা হালিশহরবাসীর জন্য অরক্ষিত ছিল? এটা মোটেই অরক্ষিত ছিল না প্রাকৃতিক ভাবে আমরা সুরক্ষিত ছিলাম। সেটা হয়ত আমি এখন আর জায়গার জন্য বলতে পারছি নাপরে এক সময় বলব।

এখন সেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সৈকত এখন টার্মিনাল বা বন্দরের অংশে পরিণত হয়েছে। বাঁধের উপর দিয়ে আন্তজেলা রাস্তাঘাট গাড়ি ঘোড়া চলাচল করছে এবং আমাদের হালিশহরের চাষাবাদ দিঘিপুকুর এবং খেলাধুলা, গরুর গাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি অথবা হাতে চালানো ট্রাক বাসের রিক্সার হর্ন সব কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার একটি বিবরণ দিতে হলে অনেক বড় একটি লেখার দরকার হয়। আশা করি যারা অতীতের আমাদের যে সম্পদশালী একটি সমাজ ব্যবস্থা এবং সুখী মানুষের যে জীবনযাত্রা ছিল এই সব বিষয়ে কেউ আগ্রহী হয়ে তারা খোঁজখবর নিবেন।

লেখক: শিক্ষাবিদ. সাহিত্যিক, কলামিস্ট।

সাবেক অধ্যক্ষচট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাইজভান্ডারী তরিকায় সুফি সংগীত : মাইজভান্ডারী গান ও সামা
পরবর্তী নিবন্ধরিজেন্সী এবং আলোর ঠিকানার জয়