বহমান সময়

শেষ ঠিকানার পাহারাদার

ফজলুল হক | সোমবার , ১ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আমার নাম ওয়াহিদা আনজুমান। আমি কিছু কথা বলার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমি আপনাকে পছন্দ করি। আনাম বললো আমিও তোমাকে পছন্দ করি, তোমার বাবা আমার পরিচিত ওনার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। উনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকুতোভয় যুদ্ধ করেছেন। ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি তিনি রাজনীতিও করেন। রাজনীতিতে তিনি একজন স্পষ্টবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি শীর্ষ নেত্রীবৃন্দের তোষামোদি কম করেন আর সেইজন্য তার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তিনি ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। কিন্তু তিনি একজন জনপ্রিয় নেতা। তিনি আমাকে তোমার বিষয়ে খুলে বলেছেন। সুতরাং আমাকে তুমি আর নতুনভাবে কিছু বলতে হবে না। সালাউদ্দীনের বাবা একজন মস্ত বড় শিপিং ব্যবসায়ী হলেও তিনি আমার ঘনিষ্ঠ মানুষ।

সালাউদ্দীন আমার সাবেক ছাত্র। আমি সালাউদ্দীনের বাবার সাথে কথা বলে তোমাকে এবং তোমার বাবাকে সব বিষয়ে জানাবো। অধ্যাপক আনাম এখন থেকে ৪৩ বছর আগে আমার সহকর্মী ছিলেন। আমরা একসাথে একই কলেজে চাকরি করেছি। সেই সময়ে আনাম আমাকে এরকম একটি ঘটনার কথা বলেছিল আজ এত বছর পর হঠাৎ সেই প্রসঙ্গটি আমার মনে পড়ে গেল। সালাউদ্দীনের বাবা আনামের সাথে কথা বলে সম্মতি প্রদান করায় সালাউদ্দীন এবং আনজুমানের বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল এবং সালাউদ্দীনের বাবা দুজনকেই আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। তাদের আন্তর্জাতিক শিপিং ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য লন্ডন এবং আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটির অফিস তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আনাম এবং আমি একসাথে সাড়ে তিন বছর চাকরি করার পর বদলি হয়ে চলে আসি। তারপর আমি অবসর গ্রহণ করার পর আনামের সাথে আমার যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন ফোন করে আনাম আমাকে হতবাক করে দেয়, সে তখন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিউইয়র্কে চলে গেছে এবং সেখানে বসবাস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে দূরে সরে যাই পৃথিবীটা এরকম। আমার পূর্বের সহকর্মীদের সাথে এখন আমার আর তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। নতুনভাবে আবার আরেকটি দুনিয়া তৈরী সেটারও কোনো সম্ভাবনা নাই।

ইতিমধ্যে একদিন হঠাৎ আনামের কাছ থেকে টেলিফোন পেলাম। আনাম আমাকে জানালো সে নিউইয়র্কে থাকে খুবই ভালো আছে। অনেক পুরোনো ছাত্রছাত্রী সেখানে থাকে। আনাম আমাকে বললো যে আমাদের আনজুমান এখন আর আগের মতো নেই, সে এখন বিশ্বের প্রভাবশালী একশজন নারীর মধ্যে তার স্থান করে নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্লেষণধর্মী ম্যাগাজিন তার কথাবার্তা এবং সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে। আনজুমান নাকি আমানকে একদিন বলেছে যে স্যার আমার বাবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি কারণ তিনি সবসময় তার চিন্তা ধারা স্পষ্টভাবে বলতেন যা তার উপরের নেতারা পছন্দ করতেন না। তোষামোদ ছাড়া রাজনীতিতে উপরে উঠার আর কোনো সুযোগ এখন আর নাই। কিন্তু আনজুমান মনে করে একসময় কূটনীতি এবং রাজনীতি যুদ্ধ এবং মিলিটারি কার্যক্রম দ্বারা প্রভাবিত হত, কিন্তু আজ কূটনীতি এবং রাজনীতি ব্যবসা দ্বারা প্রভাবিত হয়।

কোনো দেশের ব্যবসা ধসে পড়লে সে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও ও বাধা আসে। আনজুমান বলতে চাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী অনেক গতানুগতিক চিন্তার উপর ভিত্তি করে বলেছেন যে বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। এই প্রযুক্তি বিপ্লব কেমন হবে তার কিছু অংশ ফরোকাস্ট করা যেতে পারে তবে অনেকাংশ আমরা কিছু বলতে পারব না। বাংলাদেশের এই প্রযুক্তি বিপ্লবের পাশাপাশি আরেকটি বিপ্লব হবে যেটি হল উদ্যোক্তা বিপ্লব। বাংলাদেশের তরুণদের আমরা যেভাবে প্রত্যাশা করছি তারা সেভাবে বেড়ে উঠবে না। পুরানো ধ্যান ধারণা নতুনভাবে নবায়ন করে আরেকটি নতুন সমাজ তৈরী করবে না। তারা সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে আসবে আর সেইসব চিন্তাভাবনা হবে প্রযুক্তি ভিত্তিক এবং প্রযুক্তি দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে আমরা পাবো না। তারা হল উদ্যোক্তা এই উদ্যোক্তার বিপ্লব এবং প্রযুক্তি বিপ্লব এক হয়ে আমাদের সকল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চিন্তাকে একাকার করে দিবে। আনজুমান বলেছে আমি সেই দিনের চিন্তায় আছি। আমার বিনিয়োগ চিন্তার মাঝে এই বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। আনজুমান বলেছে যে, রাজনীতিবিদেরা সমালোচনা সহ্য করতে চায় না, কিন্তু তাদের সমামোচনা সহ্য করা উচিত। কারণ সমালোচনাকরে কেউ কোনো ভালো রাজনীতিবিদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। একটি উদাহরণ দিয়েছে আনজুমান যে, বংলাদেশের পদ্মা সেতু এর চাইতে শ্রেষ্ঠ কৃর্তি বাংলাদেশ সরকারের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। তারও সমালোচনা থাকবে তবে সেই সমালোচনায় কর্ণপাত করা বা গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন একটা সমালোচনা হলোনদীর উপর যখন সেতু করা তখন নদীর গতিপদ প্রবাহ বৃদ্ধি পায় না বরং বাধাগ্রস্ত হয় এই সমালোচনা করা সত্ত্বেও দুনিয়ার সব দেশে সব নদীতে অনেক অনেক সেতু ও কালভার্ট হচ্ছে কারণ সেতু না হলে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। সেইজন্য কিছু বাধা সত্ত্বেও সেতু বানাতে হবে। পদ্মা সেতু বানানোর সমালোচনা যারাই করুক না কেন এর অপরিহার্যতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া কোনো উপায় নেই। যেমন মটরগাড়ি চললে এক্সিডেন্ট হতে পারে, কিন্তু এক্সিডেন্টের ভয়ে মটরগাড়ি ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে এমন কোনো নজির পৃথিবীতে নেই। আমি আনামকে কথা সংক্ষিপ্ত করতে বললাম এবং আমি আর এইসব বিষয়ে আর শুনতে চাই না। কারণ আমি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আর দুনিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে কথা বলার আগ্রহ হরিয়ে ফেলেছি।

তারপর আমার সাথে আনামের আর কোনোদিনই যোগাযোগ হয়নি। আমি বুঝতে পারলাম আমার এক সময়ের ছাত্র সালাউদ্দীন এবং আরেক ছাত্রী আনজুমান তারা পৃথিবীর একজন প্রথম শ্রেণির ব্যবসায়ী হিসাবে অনেক ভালো ব্যবসা করছে এবং চিন্তাভাবনার দিক থেকেও আমাদের ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে। আমি খুবই আনন্দিত হলাম। সর্বশেষ টেলিফোন যখন আনামের থেকে পাই তখন আমি অবাক হয়ে যাই আনাম বলল আনজুমান তাকে ডেকেছিল ডেকে বলেছে যে সালাউদ্দীন এবং আনজুমান তাদের ব্যবসায় যে মুনাফা হচ্ছে তার এক চতুর্থাংশ তারা বাংলাদেশের মানুষের উপকারে বিনিয়োগ করবে এবং সাধারণ মানুষকে তারা সাহায্য করবে।

তারা মনে করে দেশের সরকারি এবং বেসরকারি খাতে যে উন্নয়ন হয় সেই উন্নয়ন তখনই সাধারণ মানুষের কাজে আসবে যদি উন্নয়ন থেকে প্রাপ্ত সুবিধা বেশিরভাগ গরীব মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয় বা সুবিধা দেওয়া হয়। আনজুমান ঢাকার বাইরে প্রচুর জায়গা জমি কিনে একটা প্রকল্প বানিয়েছে সেই প্রকল্পে বৃদ্ধ লোকদের থাকার সুব্যবস্থা করা হয়েছে এবং মাবাবাহীন অথবা আর্থিকভাবে দরিদ্র বাচ্চাদেরকেও সেখানে রাখা হবে। এক হাজার বৃদ্ধকে রাখার জন্য একহাজার কক্ষবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং একহাজার বাচ্চাকে রাখার জন্য একহাজার কক্ষবিশিষ্ট শিশুনিবাস নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেখানে মসজিদ নৈতিক শিক্ষাকেন্দ্র দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল এবং চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া এবং কারিগরি শিক্ষা প্রদানের জন্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বিস্তীর্ণ জায়গার ওপর কবরস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করার জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দেশের যেকোনো জায়গায় যেকোনো মানুষের মৃত্যু হলে যদি তাকে খবর দেওয়া হয় তাহলে তারা এ্যাম্বুলেন্সে করে মৃত দেহগুলো দাফনের ব্যবস্থা করে থাকে। এই কবরস্থান প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে শেষ ঠিকানা এবং পুরো প্রকল্পটির নাম হলো আনজুমান মানব সেবা কেন্দ্র। আনাম আমাকে বলল এই সেবা কেন্দ্রের চিফ এক্সিকিউটিভ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাকে আনজুমান বাধ্য করেছে এবং সে তাতে রাজি হয়েছে কিন্তু এই পুরো প্রজেক্টকে ঘিরে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হচ্ছে। সেই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান বাছাই করার জন্য তারা সারা পৃথিবী চষে বেরিয়েছে কিন্তু এখনো তারা কোনো মানুষকে নির্বাচিত করতে পারেনি।

আনাম আমাকে বলল স্যার আপনি রাজি হলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমি বললাম যে আমি চোখের সমস্যায় ভুগছি। তোমরা আমাকে আর পুরোনো জীবনে ফেরত নেয়ার চেষ্টা করো না। আনাম বলল যে আমি এই বিষয়ে আলাপ করেছি তারা বলেছে যে এখন আধুনিক যুগে কোনো চিকিৎসা অসম্ভব এমন নয়, ফলে আপনাকে সুস্থ করার জন্য তারা সবরকমের ব্যবস্থা নিবে। আপনি শুধু হ্যা বলে দেন যে আনজুমান মানব সেবা কেন্দ্রের ট্রাস্ট বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বটা আপনি নিবেন এবং পুরো প্রকল্পে সারা বিশ্বের বিভিন্ন লোকজন এনে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হবে। সালাউদ্দীনের শিপিং ব্যবসা এবং অন্যান্য ব্যবসা থেকে যে আয় রোজগার হবে তার এক চতুর্থাংশ তহবিল এখানে দেওয়া হবে। আপনি কি আমাকে হ্যাঁ বলবেন না? আমি বললাম আনাম তোমাকে না বলতে আমি অভ্যস্থ নই। শুধু এইটুকু বলি শেষ ঠিকানার পাহারাদারের দায়িত্ব নিতে আমি রাজি আছি। (ঘটনা আংশিক কল্পনা মিশ্রিত)

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।

সাবেক অধ্যক্ষচট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএম আই টি : প্রযুক্তির সৃষ্টিরহস্য খোঁজাখুজি
পরবর্তী নিবন্ধআমার বাবা, মরহুম জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী