আমাদের দেশের অনেক মানুষ দরিদ্র কিন্তু আমাদেশের দেশের মানুষ প্রচণ্ডভাবে রাজনীতি সচেতন। তরুণ–তরুণীরা গণতন্ত্র নিয়ে ভাবেন। গণতন্ত্র মানুষকে কণ্ঠস্বর দেয়। যখন মানুষের কণ্ঠস্বর উঁচু–থেকে উচ্চতর হয় তখন দুর্নীতি এবং দুনীতিবাজরা অর্থ পাচারকারীরা সর্তক হয়। যখন মানুষের কণ্ঠস্বর জোরালো হয় তখন সুশাসনের আগমন ধ্বনি শোনা যায়। গণতন্ত্র মানুষের জন্য এখন ভালো সময় নিয়ে এসেছে। বিশ্ব গণমাধ্যম গত কয়েকদিন ধরে গণতন্ত্রের বিজয়ের চাঞ্চল্যকর খবব প্রকাশ করছে। এটি ভারতের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত লোকসভার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে তার খবর।
ভারতের নির্বাচনের ঢেউ, ভারতের নির্বাচনী হাওয়া আমাদের দেশেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। আমরা দুটি প্রতিবেশী দেশ একদেশ আরেক দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ। বিশাল জনসংখ্যার দেশ ভারতে গণতন্ত্র অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হতে পারে। লোকসভা নির্বাচনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির কিছুটা মন খারাপ। নির্বাচনের ফল প্রকাশের একদিন আগেও ভারতের বাঘা বাঘা কয়েকটি গণমাধ্যম বুথ ফেরত জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে নরেন্দ্র মোদিকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হিসেবে দেখিয়ে এগিয়ে রেখেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এইসব খবর শুনে উৎফুল্ল ছিলেন। এমনকি তিনি তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কীভাবে কাজ করবেন তার ইঙ্গিত দিতেও শুরু করেছিলেন।
ভারতের গণমাধ্যম এবং বিশ্লেষকরা মোদি ম্যাজিক নামের একটি ধারণা তৈরী করেছিল। মোদি ম্যাজিক হচ্ছে উত্তর প্রদেশের অযোদ্ধায় বাবরী মসজিদের জায়গায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করা। ভারতের সংখ্যা লঘু মুসলমানদের চাপ দেওয়ার জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন তৈরী এবং তা প্রয়োগের চেষ্টা করা। বিভিন্ন নির্বাচনী বক্তৃতায় জনগোষ্ঠীকে কটাক্ষ করে কথা বলা, কংগ্রেস নেতাদের এবং বিশেষ করে রাহুল গান্ধীকে কটাক্ষ করে কথা বলা, অর্থনীতিকে সুসংহত করার জন্য মোদির প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী ভারতের ভাবমূর্তিতে জোরালো করা, জোরদার করা বিশেষ করে মার্কিং যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে হোয়াইট হাউজে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করা। চাঁদে নবযান অবতরণে সফল হওয়া এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিং নিষেধজ্ঞার সত্ত্বেও রাশিয়ার জ্বালানি– তেল এনে তা পশ্চিমাদেশে বিক্রি করে অর্থনীতিকে সচল করা। এই সমস্ত কাজের জন্য মোদি জনপ্রিয় ছিলেন বলে মনে করা হত। বিশেষ করে বিগত দুই লোকসভা নির্বাচনে মোদির অবস্থান খুবই ভালো ছিলো এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতের একজন কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেল – মোদি চারশটি আসন পাওয়ার ব্যাপারে যে উক্তি করেছিলেন সেটি মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে, এমনকি সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন থেকে ৩২টি আসন কম পেয়েছে।
অন্যদিকে কংগ্রেস এবং তাদের ইন্ডিয়া জোট তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠনের কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার মতো চমক সৃষ্টি করেছে। পশ্চিম বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক বেশি আসনে জিতে আরেক মমতা চমক বা মমতা ম্যাজিক তৈরী করেছে। কেনো ভারতীয় জনতাপার্টি নির্বাচনে আশানুরূপ সাফল্য পেলো না এখন সেটি বিশ্লেষণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যারা রাজনৈতিক বিষয় বিশ্লেষণ করে তাদের পক্ষে কোনো প্রকার তোষামোদি মনোভাব পোষণ করা ঠিক কাজ নয়। যদি সত্যি কথা বলা যায় তাহলে সেটি জনগণের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এবং সরকারের জন্য লাভ হয়। আমার মনে হয় ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারব। আমার এই বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত মন্তব্য আছে সেটি হচ্ছে, ভারতের বহু ভাষাভাষি জনগণ, বহু চিন্তা, বহু মত এবং বহু দৃষ্টিভঙ্গির জনগণ। ভারতীয় নির্বাচনে ভারতীয় জনতাপার্টিকে কাঙ্ক্ষিত ভোট প্রদান করেনি। এই প্রসঙ্গে মোদির বিভিন্ন রকমের সমালোচনা হতে পারে কিন্তু একটি প্রশংসা করি সেটি হচ্ছে, এতবড় দেশের এত বিপুল সংখ্যক ভোটারের এত বিপুল টাকা ব্যয় করে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গণতান্ত্রিতভাবে কোনো রকম হস্তক্ষেপ না করে মেনডেট নেওয়ারে কাজটি সুসম্পন্ন করে ভারত সরকার ভারতীয় জনগণকে অনেক বেশি প্রশংসিত করেছে। ভারতের গণতন্ত্রের সম্মান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
একটি সঠিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৃতিত্ব মোদিকে না দেওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। এইবার মোদির ব্যর্থতা বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা যাওয়া কয়েকটি প্রসঙ্গ আমি বলি, উত্তর প্রদেশে যোগি আদিত্ব নাথের নেতৃত্বে বিজিপির সরকার ছিলো। আদিত্ব নাথ, অমিত শা এবং নরেন্দ্র মোদি তারা বিজিপির অনেক প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু অযোদ্ধায় বাবরী মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মোদি উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ের আশায় যেসব কর্মকাণ্ড করেছেন এবং কথাবার্তা বলেছেন তা উত্তর প্রদেশের জনগণ প্রত্যাখান করেছে। অমিত শা, নরেন্দ্র মোদি, যোগি আদিত্ব নাথ তার জবাব পেয়েছেন। উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টি অকিলেস যাদব এখন পাদ প্রদীপের সামনে চলে এসেছে। মোদি যে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করে কঠোর হিন্দুদের উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছিলেন এটা কাজে আসেনি। উত্তর প্রদেশেই মোদির হার হয়েছে। তাহলে কি আমরা এটা বলতে পারি যে, ভারতের প্রগতিশীল হিন্দু জনগোষ্ঠী মোদির ধর্মীয় উম্মাদনার চিন্তা–ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করেনি? তাছাড়া সেনাবাহিনীর নিয়োগ বিষয়ে একটি খবর আমরা শুনছি এবং এই নিয়োগের বিষয়টি কিছুটা অসন্তোষ সৃষ্টি করে থাকতে পারে। ভারতের কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছে যেটা আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। তাছাড়া বেকারত্ব এবং মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টিও মোদির পক্ষে যায়নি।
ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পুরানো ধাচের মডেল সেটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজে আসলেও হয়তো বা ভারতের প্রগতিশীল এবং তরুণ প্রজন্মের মানুষ সেটিকে প্রত্যাখান করেছে। এইসব ব্যর্থতা তো আছেই তার বাইরে পরপর দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকার পর নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটি এমন ভাব ছিল যে তিনি একজন অপরিহার্য রাজনীতিবিদ অনেক রাজনৈতিক নেতা বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক দলের অনেক রাজনৈতিক নেতা নিজেদেরকে গডম্যান মনে করেন। তারা মনে করে যে, তারা ঈশ্বরের অবতার। মানুষ যারা প্রগতিশীল চিন্তা–ভাবনা করে তারা এটি গ্রহণ করে না। মোদির বিভিন্ন রকম ধর্মীয় কর্মকাণ্ড তাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হতে সাহায্য করেনি। তাছাড়া কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধিকে ব্যাপকভাবে কটাক্ষ করা মোদির জন্য একেবারেই ঠিক কাজ ছিল না। কারণ হচ্ছে রাহুল গান্ধি রাজিব গান্ধির ছেলে, রাজিব গান্ধি ইন্দ্রিরা গান্ধির ছেলে, ইন্দিরা গান্ধি জওয়াহেরলাল নেহেরুর মেয়ে এবং জওয়াহেরলাল নেহেরু মতিলাল নেহেরুর ছেলে। এই ক্ষেত্রে কেমব্রিজে লেখাপড়া করা রাহুল গান্ধিকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা মোদির একেবারে ঠিক কাজ হয়নি বলে মনে হচ্ছে। মানুষ এটিকে ঠিকভাবে গ্রহণ করেনি। তাছাড়া বিভিন্ন রাজ্যে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম মামলা দেয়া শুধু দিল্লির কেজরি ওয়ালের জন্য ঘটেছে তা নয় পশ্চিম বাংলাতেও এরকম করা হয়েছে এবং অন্যান্য রাজ্যেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এটিও মোদির জন্য সঠিক হয়নি।
পশ্চিম বাংলায় অনেক বেশি আসন পাওয়ার আসা করলেও বিজিপি ভালোভাবে হেরে গেছে পশ্চিম বাংলায়। অনেকেই মনে করছেন মোদি এমনভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল যাতে তিনি ধীরে ধীরে ভারতে এক দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা–ভাবনা সম্পূর্ণরুপে ভুল এবং তার জন্য খেসারত দিতে হয়েছে মোদিকে। কেন এটা বললাম তার উত্তর হচ্ছে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মোদি এনডিএ জোট সরকার গঠন করবেন। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হবে চন্দ্র বাবু নাইডু এবং নিতিশ এর উপরে। জনতা দল এবং তেলেগুদেশম পার্টি ভারতের এনডিএ জোট সরকারে থাকবে। চন্দ্র বাবু নাইডু এবং নিতিশ সম্পর্কে যারা জানে তাদের অনেক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং তারা ধর্মভিত্তিক চিন্তার মানুষ নন। সুতরাং মোদি এখন ইচ্ছাকৃত সবকিছু করতে পারবেন না তাদের উপরে অন্ততপক্ষে এই দুই নেতার চাপ তো থাকবে। তদুপরি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে নির্বাচনী ফলাফল হয়েছে তাতে মোদিকে অনেক সংযত হয়ে কাজ করতে হবে এবং এই জোট সরকার টিকে থাকার ব্যাপারটা একেবারে নিশ্চিত তাও বলা কঠিন। অন্যদিকে রাহুল গান্ধির নেতৃত্বে ইণ্ডিয়া জোট ভারতের লোকসভায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে এবং তারা ভবিষ্যতে আরো জোরদার ভূমিকা রাখবে। আমি এই লেখাটা যখন লিখছি তার কয়েকদিন পরে এটি প্রকাশিত হবে। সুতরাং হয়ত বা তখনকার বাস্তবতায় কিছু পরিবর্তনও আসতে পারে। তবে এখানে একটি কথা বলব সেটি হচ্ছে ভারত বাংলাদেশ বা পৃথিবীর যে কোনো দেশই হোক না কেনো গণতন্ত্র জনগণের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়।
আমাদের বাংলাদেশের জন্য ও অবাধ গণতন্ত্র দরকার যেখানে জনগণের কণ্ঠস্বর উচু থেকে উচ্চতর হয়। আমি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলতে চাই সেটি হল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন গণতন্ত্রই আমার জীবনের মূলমন্ত্র এবং শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে জনগণ রায়ই শেষ কথা। এই উক্তিটি আমি কোথা থেকে কোট করলাম সেটির উৎস হল ষাটদশকের শুরুর দিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর দৈনিক ইত্তেফাক সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা নামে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল বিশাল বড় আয়তনের এই বিশেষ ইত্তেফাক সংখ্যায় প্রচ্ছেদের উপরে সোহরাওয়ার্দীর এই বাণী লেখা ছিল। ওনাকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলা হয়। নিশ্চয়ই গণতন্ত্র এবং জনগণের রায়ের ভিত্তিতে তৈরী করা শাসনতন্ত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা এর ব্যতিক্রম চাই না।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।
সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ।