বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ৪ মার্চ, ২০২৪ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজায় ইসরাইলী সেনাবাহিনীর বর্বরতা, মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং বিদ্রোহী সেনাদের

স্বশস্ত্র সংঘাত, লোহিত সাগরে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ইরাক সিরিয়া জর্ডান সীমান্তে ইরান সমর্থিত, মিলিশিয়াদের মার্কিন স্থাপনায় আক্রমণ ও পাকিস্তান এবং ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলা এতসব খারাপ সংবাদের ভিড়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট এবং সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনের সংবাদ স্থান পেয়েছে। বিশ্ববাসী পাকিস্তানের রাজনীতি কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে, কারা সেই দেশে সরকার গঠন করছে, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে কিনা এইসকল বিষয়ে বিশ্ববাসীর মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে লেখাপড়া করিনি, সে বিষয়ে লেখারও অভিজ্ঞতা আমার নেই। তদুপরি ব্যক্তিগত কারণে আমি পাকিস্তান বিষয়ে কোনো আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী নই। তবুও পাকিস্তানের বিষয়ে একটি বিশেষ কারণে আমি আলোচনা করতে চাচ্ছি। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট। তার দুই বছর পর ১৯৪৯ সালে আমার জন্ম হয়। তখন বাংলাদেশ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অংশ ছিলো। সেই সুবাদে আমরা পাকিস্তানের নাগরিক ছিলাম। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হওয়া সত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পাকিস্তানের বাকি অংশের জনসংখ্যার চাইতে বেশি ছিলো, কিন্তু মেজোরিটি জনসংখ্যার এই অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানকে বিভিন্নভাবে শোষণ এবং বঞ্চনা শিকারে পরিণত করা হয়েছিলো। পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনকারী মুসলিমলীগ নেতাদের মধ্যে বাঙালিদের প্রাধান্য ছিলো বেশি। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলো। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে শুধু এই অঞ্চলে বাঙালিদের ভোটে মুসলমানরা ক্ষমতায় এসেছিলো, যা পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে কোথাও মুসলিমলীগ কোনো প্রদেশে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পরে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মুসলিমলীগের নেতাদের মধ্যে অধিকাংশই সামন্তবাদী পরিবার থেকে আসার কারণে তাদের সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব ছিলো। মুসলিমলীগের ভিতরে যে অংশটি খুবই জনসম্পৃক্ত সেই সকল নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় সামন্ত পরিবারের সদস্যরা বা খান বাহাদুররা ক্ষমতা বিস্তার করতে থাকে। ১৯৪৯ সালে জুন মাসে আওয়ামী মুসলিমলীগ গঠনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি নতুন অবস্থা সৃষ্টি হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে ১০ বছর একটানা পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাকিস্তানের উপর স্বৈরশাসন চালায়। এই প্রক্রিয়া অর্থাৎ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের উপরে সেনাবাহিনীর প্রভাব জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানে বহাল আছে। পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত সরকার এমনকি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও তাদের পূর্ণমাত্রায় মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। তার আগেই তাদেরকে সেনাবাহিনীর চাপে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিলো।

বর্তমানে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রীকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। তার দলকে বিভিন্ন রকমের মামলা, তাদের নেতাদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন করে তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তান তেহেরিক ই ইনসাফ দলের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার ইমরান খানকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত করে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং তারপর থেকে তার উপরে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে কানাঘুষা শোনা যায় যে, সেনাবাহিনীর অপছন্দ হওয়ার কারণে তার এই পরিণতি হয়েছে। অন্যদিকে লন্ডনে প্রবাসে থাকা সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান মুসলিমলীগ নওয়াজের প্রধান নওয়াজ শরীফকে তার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি মামলা এবং বিভিন্ন বিধি নিষেধ প্রত্যাখান করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মনে করা হয়েছে যে, নওয়াজের প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে এবং তাকে নির্বাচনে বিজয়ী করে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী করা হতে পারে। নির্বাচনে তেহরিকে ই ইনসাফ দলের প্রতীক বাতিল করা হয় তাদের দলীয় প্রধানকে দশ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। সুতরাং তেহরিক ই ইনসাফ দল সদ্য অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। তাদের দলের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, প্রতীক বাতিল হয়েছে এবং তাদের শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও নির্বাচনে বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ইমরান খানের দল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আন্দোলন করেছিলো। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব করা হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়। এতচাপ সত্ত্বেও পাকিস্তানের নির্বাচনে সে দেশের সাধারণ ভোটার তেহরিক ই ইনসাফ পার্টির পক্ষে ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছে। অন্তত সাতনব্বই আসনে তেহরিক ই ইনসাফের সমর্থক প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে জিতে এসেছে।

পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে সরকার গঠনের জন্য তাদের একশত ছত্রিশটি আসনে বিজয়ী হওয়া দরকার। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা মুসলিমলীগ নওয়াজ কোনো দলই একশ ছত্রিশ আসনে জয়ী হতে পারেনি। নওয়াজের দল পেয়েছে সত্তর আসন, পিপলস পার্টি পেয়েছে চুয়ান্ন আসন। পাকিস্তানের ভোটাররা তেহরিকে ই ইনসাফ পার্টিকে কেনো বিপুল ভোটে বিজয়ী করল, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ ব্যস্ত। সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড চাপ জনগণ প্রত্যাখান করেছে এবং ভোটের মাধ্যমে জবাব দিয়েছে। এখান থেকে স্পষ্ট হয় যে, পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে চিন্তাধারা ও ধ্যানধারণার দিক থেকে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের ভোটারদের মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি ভোটার কম বয়স্ক এবং তারা নতুন জেনারেশনের মানুষ। হয়ত তাদের কারণে সেনাবাহিনী সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করার জবাব পেয়েছে। এটি একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন। ঠিক একই ভাবে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন তখন সংবিধানের অবর্তমানে এল.এফ.ও বা লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে অর্থাৎ সামরিক আদেশের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের বাম রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলো, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো’, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। কিন্তু তখন ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের কারাগার থেকে বের হওয়া এবং ছয় দফা আন্দোলনে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে দুর্বল করে দেওয়া রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সত্তর সালের এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণ করানোর প্রস্তুতি নেন। সেই নির্বাচনে বিষ্ময়করভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলো। একশ উনসত্তরটির আসনের মধ্যে মাত্র দুটি ছাড়া একশ সাতষট্টি আসনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করেছিলো। সেটিও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর জন্য এবং সামরিক স্বৈরশাসকের জন্য একটি বিরাট বিষ্ময় ছিলো। তাদের সকল গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং তাদের চিন্তা ভাবনাকেও ব্যর্থ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে জিতে এসেছিলো। তখন পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্টের সামনে একটি পথ খোলা ছিলো, হয় আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পাকিস্তানে শাসন ক্ষমতা অর্পণ করা অথবা অন্যকিছু করা। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি তার পরবর্তী ইতিহাস এবং নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যার খবর আমাদের সকলেরই জানা। সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সাথে যোগসাজশ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্ট করে সফল হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে যখন নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, এক কোটি মানুষকে ভারতের শরণার্থী হিসেবে ঠেলে দেওয়া হয় এবং অসম যুদ্ধে বাঙালিদের অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চেষ্টা করেছে। সেই সবকিছু ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পরবর্তীকালে সামরিক শাষকদের হাতেই সেই জুলফিকার আলী ভুট্টোকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ক্ষমতাও গেছে, প্রাণও গেছে। পরবর্তীকালে ভুট্টোর কন্যা বেনজীর ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব করেছেন এবং রহস্যজনকভাবে তারও মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে তার দল পিপলস পার্টি নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের নির্বাচনী হিসাবে তিন নম্বর স্থানে অবস্থান করছে। হয়তো বা জোট গঠনের মাধ্যমে মুসলিমলীগের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা সামনে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসতেও পারে। পাকিস্তানের বর্তমান নির্বাচনে জনগণ যেভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ইঙ্গিত দিয়েছে যে সেনাবাহিনী যতই ক্ষমতাশালী, যতই শক্তিশালী হোক শেষ পর্যন্ত জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছে তাকে হার মানতেই হবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একই ঘটনা ঘটেছিলো, জনগণের রায়ের কাছে সেনাবাহিনীকে মাথানত করতে হয়েছিলো। ইতিহাসের এই শিক্ষা সামরিক শাসক এবং রাজনীতিবিদগণ লক্ষ করেন কিনা সেটা দেখার বিষয়। পাকিস্তানের নির্বাচনী চমক এখনো শেষ হয়নি। ইমরান খান জোট গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং সম্ভাব্য জোটের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ওমর আয়ুব এর নাম ঘোষণা করেছেন। ওমর আয়ুব হচ্ছেন পাকিস্তানের সাবেক সেনা রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের নাতি। সম্প্রতি পাকিস্তানের এই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে একজন নির্বাচনী কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন এবং দায় স্বীকার করে তিনি পদত্যাগ করেছেন ইমরান খানের দল পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন প্রদেশে অনেক বেশী আসন পেয়েছে। সেখানের তারা জনসমর্থনের দিক থেকে ভারী। ইমরান খানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে না দিলে খাইবারের পাখতুন জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে গণমাধ্যমে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। হয়তো তারা বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করতে পারে। গণমাধ্যমের খবর থেকে যা বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ মডেল বলতে বঙ্গ বন্ধুকে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী ক্ষমতা না দেওয়ার পরে যা ঘটেছিলো সেইরকম একটা কিছু। সেইরকম কিছু ঘটলে হয়তো তার দায়ভার ইমরান খানের উপরে চাপাতে পারে। গণমাধ্যমে এমনও শোনা যাচ্ছে যে পাকিস্তানের জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উপরে একটি অদৃশ্য ছায়া বিরাজ করছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইটভাটা যেন স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণের কারণ না হয়
পরবর্তী নিবন্ধতাহেরিয়া ছালেহা আনজুমান সুন্নিয়া মাদ্রাসার পুরস্কার বিতরণী