বসন্তের রঙ এবং ভালোবাসার আবেশ। দু’য়ের সম্মিলনে গতকাল দিনভর উজ্জ্বল ছিল বইমেলা। প্রেমিক–প্রেমিকা এবং বসন্তপ্রেমীদের পদচারণায় রঙিন হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ নগরের সিআরবি শিরীষতলা। বইমেলার একশ গজ দূরত্বে সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে সকালে শুরু হয় বসন্ত উৎসব। তার সঙ্গে মিল রেখে বিকেল থেকে এগিয়ে বইমেলার দরজা খোলা হয় সকাল ৯টায়। অতঃপর প্রিয়জনকে নিয়ে বসন্ত উৎসবে যোগ দেয়া সেই প্রেমিক ও বসন্তপ্রেমীদের পাশাপাশি শহরের অন্যান্য জায়গা থেকে লোকজন ছুটে আসেন বইমেলায়।
সকাল, দুপুর এবং বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়েছে। তবুও যেন ক্লান্তি নেই পাঠক–দর্শনার্থীর। ঘুরেন এক স্টল থেকে অন্য স্টলে। কিনেন পছন্দের বই। বসন্ত ও ভালোবাসার আমেজ থাকা এমন দিনে হাসি ফোটে প্রকাশকদের মুখেও। কারণ এ বছর মেলা শুরুর পর বিক্রির সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় এদিন।
চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি মো. সাহাব উদ্দীন হাসান বাবু আজাদীকে বলেন, কোনো কোনো স্টলে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বেচাকেনা হয়েছে। এর বাইরে বেশিরভাগ স্টলে গড়ে ৭০–৭৫ হাজার টাকা করে বেচাকেনা হয়েছে। সবমিলিয়ে কোটি টাকার মতো বিক্রি হয়েছে।
‘সময়ের কাটাছেঁড়া’ গ্রন্থের লেখক মহসীন কাজী আজাদীকে বলেন, আজকের উপস্থিতি প্রমাণ করে পাঠক কমেনি। পাঠক পাঠকের জায়গায় আছেন। সমাাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে বই পড়ুয়া কমেছে বলে যে ধারণা করা হয় তা ভুল। পাঠক যদি কমে যেত তাহলে এত বই তো বিক্রি হতো না। প্রকাশকরাও এত বই প্রকাশ করতেন না। তিনি বলেন, মানুষ মনে করেছিল সিআরবি’তে বইমেলা জমবে না। সেটাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই জমেছে। আজ (গতকাল) তো জমজমাট।
এবার বইমেলা উপলক্ষে ৩২টি বই বেরিয়েছে মূর্ধন্য প্রকাশন থেকে। সংস্থাটির প্রতিনিধি অনিক ধর আজাদীকে বলেন, বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস এবং পূজা তিনটা উপলক্ষ একদিনে হওয়ায় মেলায় প্রচুর লোকজন এসেছেন। বেচাকেনাও মোটামুটি হচ্ছে।
কথাপ্রকাশ এর বিক্রয়কর্মী রাসেল আহমেদ রাজু আজাদীকে বলেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় বিক্রি একটু বেশি। কিন্তু যে পরিমাণ লোকসমাগম সে তুলনায় কিছু না। এবার ৭০টা বের হবে কথাপ্রকাশ থেকে। এর মধ্যে ৪০ টা চলে আসছে। এবার থ্রিলারধর্মী বই বেশি বিক্রি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
আপন আলো প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী শামসুদ্দিন শিশির আজাদীকে বলেন, সব বই চলছে। নৃ–গোষ্ঠির বই বেশি চলছে। অন্বেষা প্রকাশন এর বিক্রয়কর্মী মো. ইমরান আজাদীকে বলেন, এবার ৮ টা বেরিয়েছে। এর মধ্যে ৫টা এসেছে। আজ লোকজন বেশি। বেচাকেনা গত কয়েকদিনের চেয়ে বেশি। তবে খুব বেশি বলা যাবে না। মোটিভিশনাল বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০২০ সাল থেকে চট্টগ্রামের বইমেলায় অংশ নিচ্ছি। কোয়ালিটি কমেছে। আয়োজকদের পক্ষে যে পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা তা দুর্বল হয়েছে। আগে ইট ছিল এবার ত্রিপল। অনেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে।
নতুন বইয়ের খবর : বইমেলায় নতুন আসা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কিশোর থ্রিলার ‘লাল বাড়িটা ডেঞ্জারাস’, জসীম চৌধুরী সবুজ এর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘মূল্যবোধের সংকট ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন‘, কামরুল হাসান বাদল এর গল্পগ্রন্থ ‘খুন ও হুইসেল’, মাইনুল এইচ সিরাজী এর থ্রিলার ‘শনিবার মধ্যরাতে’, ড. এস এম আবু জাকের এর উপন্যাস ‘বুনো ফুলের শোভা’, জোনাকী দত্তের ‘টুনটুনির বিয়ে’ ও মহি মুহাম্মদ এর ‘আড়াইপাতা’।
‘বন্ধু শিহাবকে নিয়ে মামাবাড়িতে বেড়াতে এসেছে রাজীব। হঠাৎ জানা গেল, গ্রামের শেষ মাথায় একটা ভুতুড়ে বাড়ি আছে। ভয়ে কেউ সেখানে যায় না। গেলে ফিরে আসতে পারে না। রাজীবের বন্ধু শিহাব দারুণ সাহসী ছেলে। লাল বাড়িটার ভেতর ঢুকতে চায় সে। বাড়িটা কিন্তু ডেঞ্জারাস!’ শিহাব কি শেষ পর্যন্ত বাড়িটাতে ঢুকতে পেরেছে? শিহাব ও রাজীব কি ভুতুড়ে সে বাড়ির রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছে? তা জানা যাবে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘লাল বাড়িটা ডেঞ্জারাস’ গ্রন্থে। বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, আগে শিশু–কিশোরদের জন্য ছড়া, কবিতা ও গল্প লিখেছি। কিন্তু কিশোর উপন্যাস এটিই প্রথম।
এবার প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পর্কে জসীম চৌধুরী সবুজ আজাদীকে বলেন, ‘মূল্যবোধের সংকট ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন গ্রন্থে সন্নিবেশিত নিবন্ধসমূহে বিবিধ বিষয়সমূহ উঠে এসেছে। প্রতিটি লেখা ইতোপূর্বে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে সীমিত একটি পরিসরে। সেগুলো পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে গ্রন্থভুক্ত করা হয়েছে। গ্রন্থভুক্ত অনেকগুলো নিবন্ধ দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
‘শনিবার। অমাবস্যার রাত। শিহাবের কাছে কে আসবে ঠিক রাত বারোটায়? অলৌকিক কিছু, আরেকটা শিহাব–বৃদ্ধ শিহাব, নাকি পুরোটাই বিভ্রম? আতঙ্কিত আর শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষা শিহাবের। জগৎ–সংসারের হাল ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল শিহাব। এলোমেলো পা ফেলে কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিল। অতঃপর…।’ অতঃপর কি হয়েছে তার উত্তর মিলবে মাইনুল এইচ সিরাজী’র ‘শনিবার মধ্যরাতে’ গ্রন্থে।
‘নিভৃত এক পল্লীতে রুবেলের বেড়ে উঠা। শিক্ষা জীবনের প্রারম্ভেই মুক্তিযুদ্ধের দামামা শুরু। রাজাকারদের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সে। সফলও হয়। খেতাব পায় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। প্রকৃতিকে ভালোবেসেছিল খুব। প্রকৃতিও তাকে নিরাশ করেনি। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পথে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। শত প্রতিকূলতাকে জয় করে উচ্চ শিক্ষার পথে শহরে পা বাড়ায় রুবেল। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত অধ্যয়নের যে মনস্কামনা তা নানা প্রতিকূলতা, আর্থিক দৈন্যতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রেমের নিপীড়ন, অমানবিক পরিশ্রম–সব কিছুকে ছাড়িয়ে পূরণ হয় শেষ পর্যন্ত। চারিত্রিক দৃঢ়তা, উচ্চাকাক্সক্ষা এবং বৈরি পরিস্থিতি মোকাবেলার অদম্য মানসিক শক্তি সাফল্য অর্জনে মূল মন্ত্র ছিল। যাত্রাটি তবে মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়’। এ বন্ধুর পথ–পরিক্রমা চিত্রিত হয়েছে যুব চরিত্র সুসংহতকরণের উপন্যাস ড. এস এম আবু জাকের এর ‘বুনো ফুলের শোভা’য়।