বর্ষা এলো

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৫ জুন, ২০২৪ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

পোড়ায় ভীষণ যখন তখন, বুকের জমাট ক্ষত/ ডানপিটে মন ডানা ঝাপটায়, স্বার্থপরের মতো।/ জটিলসরলমিষ্টিগরল, ঘামে ভেজা অনুতাপ/ আজ বরিষার আমন্ত্রণে, ধুইয়ে মুছে হোক সাফ।’

বর্ষার সাথে সমঝোতা রেখে চলা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। তীব্র তাপদাহ, অসহ্য লোডশেডিং আর গরমে যখন প্রাণশক্তি নিঃশেষিত, বর্ষার আগমন যেন প্রকৃতির নির্মম উপহাস। তবু সে এসেছে আজ, প্রতি বছরই আসে নিয়ম করে। তাতে প্রেম ও বিরহের উত্তাল আবেগে বাঙালির প্রাণে এখন কতটা দোলা লাগে তা বিচারের ভার বুদ্ধিজীবী, শিল্পসাহিত্য বোদ্ধাদের জন্য তোলা থাক।

কদম ফুলের শরীর ছুঁয়ে উড়ে যায় মেঘবতী বৃষ্টি। মনের গভীরে নির্জন জলের রং ছড়িয়ে দেয় নিকোটিনের লোভ। যুবতী মেঘের ছায়ায় কদম ফুলের স্নিগ্ধতা লাজবতী হয়ে উঁকি দেয় হূদয়ের উঠানে। নিকোটিন পোড়া ধোঁয়া ভিজে যায় জানালার ওপারে যেখানে থৈ থৈ জলের শরীরে বৃষ্টি নুয়ে পড়ে। বর্ষা এলেই এমনটি অনুভূত হয় মন মন্দিরে।

বর্ষা যখন আসে তীক্ষ্ন সবুজ বাংলার স্নিগ্ধ প্রতিকৃতি আস্থা আর বিদীর্ণ হতাশার সম্মিলিত উন্মোচনে উড়িয়ে দেয় অশ্রু ভাষা। মহাকবি কালিদাস দুর্গম কৈলাস শেখর নীলগিরিতে বিরহিনী প্রেয়সীর কাছে দূত করে মেঘকে পাঠিয়েছিলেন যক্ষের বার্তা নিয়ে। সেই থেকে বর্ষা যেমন মিলনের নদীতে বিরহের শ্যাওলা জমায়, তেমনি অনুভব করতে শেখায় ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণ সখা বন্ধু হে আমার।’

বর্ষা আবেদনময়ী। কবিসাহিত্যিকদের কাছে তো বটেই। ঘন ঘোর বরিষায় তারে কত কী বলতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ! পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে কবিগুরুর পাগল মন নেচেছে বহুবার। ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে কিছুতেই কোনো কাজে মন না লাগার আক্ষেপও ঝরেছে তাঁর কথায়, লেখায়। রবীন্দ্রনাথ থেকে হুমায়ূন আহমেদ সকলেই বর্ষা এলে উদাস হন। ঝুম বৃষ্টিতে খোলা রিকশায় চেপে হিমু হয়ে ঘুরে বেড়ানো তো বর্তমান তারুণ্যের ট্রেন্ড হয়ে গেছে। প্রেমিক যুগল বরিষ ধারা মাঝেই খুঁজে নেয় শান্তির বারি। তাদের কাছে বর্ষা মানে সবুজের মাঝে মুক্তির দিশা। বর্ষা মানে প্রকৃতি সৃষ্টি সম্ভবা, ঋতুবতী হয়ে ওঠা; তার মাঝে জন্ম ও জীবনের ঘ্রাণ খুঁজে পাওয়া।

বর্ষা মানে পুরনোকে পিছু ফেলে নতুন আশায় বুক বাঁধা। কবির কাছে বর্ষা তাই রুক্ষ পৃথিবীর বুকে একমাত্র মরুদ্দান; চিত্রিতশোভিতরূপময় কাম বিমোহিত, মিলনপিপাসু বিরহ কাতর মন। বর্ষা মানে মানবমানবীর কামনা সিঞ্চিত বিরহ বিধুর হৃদয় মথিত কাব্য। কিন্তু শহুরে পটে বর্ষা আসে ভিন্ন রূপে; তার সর্বত্র খেলা করে অস্থিরতা। সে শুধু ভিজিয়ে দেয় না, ভাসিয়ে দেয়। চোখে তার লেগে থাকে ঘুম, তবু রাত্রির সহবাসে সে তৃপ্ত নয়। তার চাওয়া বাড়তেই থাকে ক্রমাগত। বাড়তে বাড়তে আকাশ স্পর্শ করেও সাধ মিটে না। লকলকে জিহ্বায় তার মৃত্যু পরোয়ানা, চেটেপুটে নেয় যত প্রেম, সৌন্দর্য, স্নেহ আর মমতা। তাই বর্ষা আসার আগে থেকে বিদায়ের প্রস্তুতি চলতে থাকে। যারা তার হিংস্র থাবা থেকে রক্ষা পায়, তারা প্রস্তুত হতে থাকে আগামী বছর ঠিক এই সময়টার জন্য। অথচ আজো বর্ষা চির প্রত্যাশিত হৃদয়ে। বর্ষা এলেই জীর্ণ স্মৃতির মলাটে আবীর ছড়ায় ধোঁয়াটে স্মৃতিরা। এমন এক সময় বর্ষা আসছে যখন ক্ষয়ে যাওয়া জানালার কপাটে মাথা ঠুকছে স্বপ্নীল আকাশ। যান্ত্রিক নাগরিক জীবনে প্রতিনিয়ত দখল হয়ে যাচ্ছে কুমারী আবেগ। প্রকৃতির চিরায়ত নিয়মে বর্ষা আসে। তবে সেই বর্ষা আসে কালে ভদ্রে, যে বর্ষায় মিনতি করতে হয় ‘ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’।

এখন বর্ষা আসে ‘উত্তপ্ত কাঞ্চনাং রমণীয় মূর্ত্তিম’ বেশে। আকাশ পানে চোখ ফিরাতেই দেখি মেঘরোদ্দুর দাপাদাপি করছে। কোথাও কালো, কোথাও ধূসর মেঘগুলো যেন চোখের নিমিষে পড়শিকে সামনে দেখতে চায়। কে কেন কী বলল তাতে কিছুই আসে যায় না। বর্ষা এলেই তাই অবচেতন মনেই প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, ‘দূর আকাশের খিড়কি খুলে বৃষ্টি পড়ুক টাপুর টুপুর, বুকের মাঝে বৃষ্টি ঝরুক, বৃষ্টি ঝরুক সকালদুপুর।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধআওয়ামী লীগ নেতা বাবুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
পরবর্তী নিবন্ধমহানগর বিএনপির নেতৃত্বে কারা আসছেন