দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্য কে বা কারা দায়ী। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের অধিকাংশই চিহ্নিত। ১৯৭৫ পরবর্তী দীর্ঘসময় সেনা–স্বৈর শাসকদের যাঁতাকলে জাতি ছিল নিষ্পেষিত। বিশ্বে বিরল হৃদয় বিদারক উল্লেখ্য জঘন্য হত্যাকান্ড এখনও প্রতিনিয়ত বাঙালিদের যন্ত্রণাদগ্ধ করে চলছে। পিতামাতা–ভাইবোনসহ নিকট আত্মীয়দের হারিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শোকাতুর আর্তনাদে অবিরত কাঁদছে। প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবনের কঠিন কষাঘাতে জর্জরিত বড় কন্যা শেখ হাসিনা দেশবাসীর মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে নিঃসঙ্কোচে জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন যে বাংলার জনগণের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করবেন। শত বাধাবিপত্তি–বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে সেদিন প্রায় ১৫ লক্ষাধিক জনতা কুর্মিটোলা বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগরে তাঁকে এক নজর দেখা এবং বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে জাগ্রত করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে জড়ো হয়েছিলেন। অঝোরে বৃষ্টিধারার সাথে তাঁর ও জনগণের ব্যথাতুর কান্নার জল একাকার হয়ে সেদিন বাংলার প্রকৃতি অভূতপূর্ব শোক–আনন্দাশ্রিত রূপ পরিগ্রহ করে।
১৭–১৮ মে ২০২৪ দৈনিক জনকন্ঠে ‘শেখ হাসিনা ফিরলেন, প্রাণ পেল বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে মহামান্য রাষ্ট্রপতি লিখেছেন, ‘এটি নিছক কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস নয়; গণতন্ত্র পুনর্জাগরণের দিন ছিল ১৭ মে, ছিল বাংলাদেশের আপন কক্ষপথে ফেরার দিন, সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পুনরায় বাংলাদেশ হয়ে উঠার দিন। আপনি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে পছন্দ করুন বা না করুন; একটি দিকশূন্য টলায়মান জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে ঐ সময়ে তার প্রত্যাবর্তন যে কতটা জরুরি ছিল, তা চলমান পরিস্থিতি সামনে রাখলেই অনুভব করতে পারবেন। আরও অনুভব করা যাবে গত ১৫ বছর ধরে চলমান বাংলাদেশের আকাশছোঁয়া উন্নয়ন দেখলেও। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে অকুতোভয় নেতার অভাব হয়তো কখনো ছিল না; কিন্তু জাতির ক্রান্তিলগ্নে, স্বাধীনতা–উত্তর ও বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী বাংলাদেশে আলোকবর্তিকা হয়ে ধীমান নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ একজনই সাহস দেখিয়েছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সুতরাং তাঁর প্রত্যাবর্তন অতীতের সংকটকালীন বাংলাদেশের জন্য জরুরি ছিল, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্যও জরুরি থাকবে।’
মূলত বিরাজিত সকল অসঙ্গতি–বিভ্রান্তি–অন্ধকারের শক্তির সকল কদর্য পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা পুনরুদ্ধার সংকল্পে অবিনাশী দেশপ্রেমে ঋদ্ধ হয়ে তিনি দেশে ফিরার সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। দেশে ফিরেই দলের সভাপতির অর্পিত দায়িত্বভার গ্রহণ করে গড়ে তোলেন সামরিক সরকারবিরোধী গণআন্দোলন। বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার আদায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বহুবার সামরিক–স্বৈরশাসকদের রোষাণলে পড়েছেন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে স্বৈরশাসকদের আজ্ঞাবহ পুলিশ ও বিডিআর বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বিভীষিকার ২৯ বছর পর পুনরায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নির্মিত হয় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ আরেক অধ্যায়। ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুনীতিবিরোধী’ সমাবেশে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে একের পর এক গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। তিনি সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হয়েছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা–কর্মী। এছাড়াও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন কয়েক শত নেতা–কর্মী। স্প্লিন্টারের অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে ঘটনার দেড় বছর পর মারা যান ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মোট ১৯ বার হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। তাঁকে হত্যা চেষ্টার ঘটনাগুলোর মধ্যে– নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজি–বি কর্তৃক ২০০০ সালের ২০ জুলাই কোাঁলীপাড়ায় সমাবেশস্থল ও হেলিপ্যাডের নিকটে দুটি শক্তিশালী বোমা এবং ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় বোমা পুঁতে রাখা, ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে হত্যার পরিকল্পনা, ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা, ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চতুর্থ জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ধানমন্ডির গ্রীন রোডে ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় গুলি ছোড়া, ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রেনমার্চ করার সময় পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে ট্রেনের বগি লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ, ১৯৯৫ সালের ৭ মার্চ শেখ রাসেল স্কয়ারে সমাবেশে চালানো সশস্ত্র হামলা ও ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছোড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী অকুতোভয় সংগ্রামী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ এবং সরকার পরিচালনায় যে অবিনশ্বর কার্যক্রমের জন্য তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন, তাহলো জাতির জনকের হত্যার বিচার–দাবি এবং ঐতিহাসিক এই বিচারিক রায়ের কার্যকর বাস্তবায়ন। অত্যন্ত স্বচ্ছ–জবাবদিহিমূলক বিচার কার্যক্রমের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সাথে সংশ্লিষ্ট স্বল্প সংখ্যক অপরাধীদের বিচার–বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এতে জাতি শুধু কলঙ্কমুক্ত হয়নি; বিশ্ববাসীসহ সমগ্র মানবিক সমাজ হয়েছে অপরিসীম অনুপ্রাণিত। জাতি দৃঢ়তার সাথে প্রমাণ করেছে কোন অন্যায় অবিচার কখনো নন্দিত হতে পারে না, তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশে সমাজকে কলুষমুক্ত করার দৃষ্টান্তই সভ্যতার মৌলিক স্মারক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য উল্লেখ্য হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্র তৈরি–অপকৌশল প্রণয়ন–বাস্তবায়নের আড়ালে ক্ষমতা–অর্থলিপ্সু মানবরূপী দানবেরা বরাবরই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। খুনি মোশতাক গংদের বংশবদরা অত্যধিক বংশ বিস্তার করে অভিশপ্ত নাগ–নাগিনীর ভয়ঙ্কর ছদ্মবেশ ধারণ করেছে।
জনশ্রুতিমতে, ঐ সময় থেকে শুরু করে যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাক গংদের সাথে হাত মিলিয়ে আনন্দ উল্লাস করেছিল তাদের অনেকেই সরকারে মন্ত্রীর পদেও অধিষ্ঠিত ছিল। প্রতারণা–জালিয়াতি–মিথ্যাচার–ছলচাতুরী–অভিনয় শৈলী ও অবৈধ–অনৈতিক অর্থ লেনদেন–তদবির–লবিং বাণিজ্যের বদৌলতে উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই তারা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। ছদ্মবেশী এসব বর্ণচোরারা ক্ষমতার সুবিধাভোগী হয়ে অপকৌশলের মাধ্যমে দীর্ঘসময় আন্দোলন–সংগ্রামে থাকা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের পরীক্ষিত নেতা–কর্মীদের প্রায় কোণঠাসা করে রেখেছে। অবমূল্যায়নের কাতরতায় তাদের দীর্ঘশ্বাস শুধু দীর্ঘায়িত হচ্ছে না; ক্ষেত্র বিশেষে দল অভিশপ্তও হচ্ছে বটে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় ন্যূনতম বিশ্বাসী না এমন ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন জাতি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। দুর্বৃত্তায়নের ফলশ্রুতিতে তাদের পেশী–অর্থশক্তির দৌরাত্ম্য বেপরোয়া আকার ধারণ করেছে। কতিপয় মন্ত্রী–এমপি থেকে শুরু করে এদের অনেকেই ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’ হওয়ার মত দৃশ্যপট তৈরি করেছে। ভূমি–জল–ঠিকাদারি–নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য–কৃষি পণ্যসহ দেশের সকল আর্থ–সামাজিক খাত পরিপূর্ণ তাদের দখলে।
এসব ঘৃণ্য অপরাধীদের বিভিন্ন পদ–পদায়ন ও পদক আদায়ে কদর্য পারদর্শীতা সম্পর্কে কারো অজানা নয়। গণমাধ্যমে রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো সংস্কারে তাদের দুর্নীতির চিত্র অহরহ প্রকাশ পাচ্ছে। রাস্তা মেরামতের সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পিচঢালা পথগুলো উলঙ্গ হয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। কার্যক্রম সম্পাদনে নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এতে যেন কোনো দায় নেয়। নিকৃষ্ট নির্লজ্জের মত শুধু তদন্ত কমিটি করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা শোনা গেলেও এ পর্যন্ত কয়টি ঘটনা বিচারের মুখোমুখি হয়েছে তা কিন্তু জনগণের অজানা। দেশে বিদেশে এসব দুর্বৃত্তের অপকর্মের শেকড় এতবেশি গভীরে প্রোথিত; তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ দুরূহ হয়ে পড়েছে। ন্যূনতম বিরুদ্ধাচরণ বা তাদের বিপক্ষে যায় এমন সব মন্তব্য–লেখালেখি–মত প্রকাশে সাহসীক ব্যক্তিদের ফাঁসিয়ে দিয়ে অহেতুক হয়রানি–নির্যাতন–নিপীড়নের ব্যবস্থাও তাদের কুক্ষিগত।
পরশ্রীকাতর–দেশবিরোধী–সুবিধাভোগী বিদেশী এসব অনুচরেরা হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ–আবিষ্কার করার ব্যর্থতার কুৎসিত চিন্তা–চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়ে এখনও দেশব্যাপী নানামুখী চক্রান্ত–ষড়যন্ত্রের দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মাণ করে চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য অগ্রযাত্রায় দেশের আকাশচুম্বী উন্নয়ন মাইলফলক স্থাপন দেশ–জনগণকে বিশ্বপরিমন্ডলে উচুঁমাত্রিকতার মর্যাদায় সমাসীন করেছে। দেশপ্রেমিক–সৎ ও যোগ্য চৌকস ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন ও সত্য–বস্তুনিষ্ঠ–নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণে মুখোশধারী বর্ণচোরাদের দেশবিরোধী অব্যাহত চক্রান্ত–ষড়যন্ত্র উন্মোচন অতীব জরুরি। অতি দ্রুত এদের মুখোশ উম্মোচন করে যথার্থ বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বাঙালিদের অসহায় আর্তনাদ দীর্ঘায়িত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়