পৃথিবীর যে দেশ যত বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সেই দেশ তত বেশি উন্নত। সে জন্য উন্নত বিশ্বে গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে শুরু করে কোনো প্রকার বর্জ্য মানুষের নজরে পড়ে না। এর প্রধান কারণ হলো উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ঐসব দেশে বড় বড় ড্রামের মধ্যে ততোধিক বড় পলিথিন লাগানো হয় ময়লা ফেলার জন্য। ময়লায় ড্রাম পুরে গেলে পলিথিনের মুখ দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় সিটি কর্পোরেশন হতে পরিচ্ছন্ন কর্মী এসে সেই ময়লা ভর্তি পলিথিনগুলো ডাম্প ট্রাকে করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে প্রথমে এর উপাদানগুলো আলাদা করা হয়। সেই পৃথককৃত উপাদান হতে প্রক্রিয়াজাত করে বায়োগ্যাস, রিসাইকেল পলিথিন চিপস, কম্পোস্ট সার, নির্মাণবর্জ্য পুনব্যবহার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এতে বর্জ্য থেকে কোনো প্রকার ক্ষতিকর গন্ধ বা উপাদান বাতাসে বা মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে না। ফলে পরিবেশ থাকে ইকো ফ্যান্ডলি। আরো মজার বিষয় হলো, কোনো কোনো দেশে এই কাজগুলো করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। তারা মূল্য দিয়ে ঐসব বর্জ্য কিনে নেয়। এতে সিটি কর্পোরেশনের কোটি কোটি টাকা আয় হয়। আবার অনেক দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় বর্জ্য কালেকশন করে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বুঝায় বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়া জাতকরণ, পুনর্ব্যবহার (Recycling) এবং নিষ্কাশনের (Disposal)সমন্বিত প্রক্রিয়া। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্য থেকে পরিবেশের ক্ষতি রোধ করা এবং বর্জ্য থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বস্তু আহরণ সংক্রান্ত কাজও করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্যকোনো শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়নি। এখনো এই শহরগুলোতে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চলছে সনাতন পদ্ধতিতে। অথচ সময় এসেছে সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের। তবে এই পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন আধুনিক ও পরিবেশসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এতে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়।২০১৯ সালে এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে উভয় কর্পোরেশন। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ঐ বছর নভেম্বরে পাঠানো হয় স্থানীয় সরকার বিভাগে। যার কোন মতামত এখনো পাওয়া যায় নি। এরমধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশন এই পরিকল্পনা হতে সরে এসেছে। ঢাকার সিটি কর্পোরেশনের এলাকা নিয়ে পরিকল্পনা হলেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নিয়ে কখনো এই ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয় নি। সে প্রেক্ষিতে সমপ্রতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয় চট্টগ্রামে প্রতি দিন ৩,০০০টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার মধ্যে সিটি কর্পোরেশন ২,০০০টন বর্জ্য কালেকশন করে বাকী ১,০০০টন বর্জ্য নালা-নর্দমা, খাল-বিল, নদী ও উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকে। এই বর্জ্যের জন্যই চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। প্রতিবেদনটির তৈরীর সময় হলো ২০১৯-২০। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট কোনো বিভাগ নেই। পরিচ্ছন্নতা বিভাগের আওতায় বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণের কাজ চলে। তবে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ মোটামুটি চললেও পরিবহন ও অপসারণের কাজ পরিবেশ সম্মত নয়। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগরের ৫০ লাখ মানুষ প্রতিদিন ৬০০ গ্রাম করে বর্জ্য উৎপন্ন করে। এরমধ্যে ১,৮৩০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য, ৫১০ টন সড়ক ও অবকাঠামোগত বর্জ্য ও ৬৬০টন মেডিকেল বর্জ্য।নগরে এখনো ৫১৪টি উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলা হয়। কংক্রিটের ডাস্টবিন আছে ২৬৩টি ও কন্টেইনার আছে ৭০টি। সংগৃহীত বর্জ্য হালিশহরের আনন্দবাজার ও আরেফিন নগরে উম্মুক্ত ল্যান্ডফিল্ডে ফেলা হয়। তবে এই দুইটি ল্যান্ড ফিল্ডের অবস্থা ভালো নয়। এখান থেকে নিয়মিত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
ঢাকা সিটিতে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপন্ন হয় ৯,০০০টন। যার মধ্যে ৭৯% হলো খাদ্য দ্রব্য বর্জ্য। অন্যদিকে সারাদেশে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপন্ন হয় ৩২১৬৫ টন। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য বৈজ্ঞানিক ভাবে কালেক্ট করে প্রসেস করতে পারলে সরকারের কোটি কোটি টাকা আয় হবে ও পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকবে।
তবে আশার কথা হলো গৃহস্থালীর বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের দুই শিক্ষার্থী এইচ এম রঞ্জু ও পীযুষ দত্ত। গত মার্চ থেকে তাদের যন্ত্রটি তেল ও গ্যাস উৎপাদন শুরু করেছে। এতে লাভের পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ বলে তারা জানিয়েছেন। রাজধানীর মাতুয়াইলে তুষারধারা এলাকায় প্রায় সাত কাঠা জমির ওপর বানানো প্ল্যান্টটি থেকে পাওয়া যাচ্ছে গ্যাস ও জ্বালানি তেল। এ ছাড়াও এতে আরও সাত প্রকারের দ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানান তারা। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকরণ যুক্ত করে যন্ত্রটির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনও করা যাবে। এতে ইউনিট প্রতি খরচ পড়বে সাড়ে ৫ টাকা থেকে পৌনে ৬ টাকা। ২০২০ সালের নভেম্বরে প্ল্যান্টটি স্থাপনের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় এ বছরের মার্চে আর উৎপাদন শুরু হয় ২৭ মার্চ। এতে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
বর্জ্য থেকে তেল ও গ্যাস উৎপাদনের জন্য এই দুই তরুণ ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গবেষণা করেন। তাদের গবেষণার সার্বিক তদারকি করেছেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তসলিম-উর-রশিদ, প্রভাষক সাজিদুল ইসলাম ও বাংলাদেশ অ্যাডভান্স রোবটিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিমি মজুমদার।
তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে দেশে দৈনিক উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৬,৪৯৩ মেট্রিক টন। ২০১৪ সালে এসে তা দাঁড়ায় ২৩,৬৮৮ মেট্রিকটনে ও ২০২৫ সালে দাঁড়াবে ৪৭,০০০মেট্রিক টন। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ দিনে ৩২,১৬৫ মেট্রিকটন। এ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা না গেলে পরিবেশ বিপর্যয় হবে। রঞ্জু ও পীযুষের প্ল্যান্টটিতে প্রতি ১০০ মেট্রিকটন বর্জ্য থেকে ৯.২১ মেট্রিকটন জ্বালানি তেল, ২.১২ মেট্রিকটন গ্যাস, ০.৫০ মেট্রিকটন অ্যাকটিভেটেড কার্বন, ০.৯৩ মেট্রিক টন হাইড্রোক্লোরিক এসিড, ২০.৬৫ মেট্রিকটন ড্রাইআইস ২১.৫৫ মেট্রিক টন বায়োইথানল ও ১১.২ মেট্রিকটন জৈবসার উৎপাদন সম্ভব। প্রযুক্তিটি পরিবেশবান্ধবভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং প্ল্যান্টে বর্জ্যশোধনের কাজটি পুরাপুরি স্বংয়ক্রিয়ভাবে হবে। এতে কোনো উচ্ছিষ্ট থাকবে না। তারা জানান, প্লান্টের পেট্রোলিয়াম গ্যাস এলপিজি হিসেবে বাসা বাড়ির রান্নার কাজে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া একে সিএনজিতেও রূপান্তর করা যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে,২০১৮ সালে দেশে যে বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছিল, তা দিয়ে ২৩,১৪,৭৬৫.৫৩ মেট্রিকটন জ্বালানি তেল উৎপাদন করা সম্ভব হতো। যা দেশের আমদানি চাহিদার ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া এসব বর্জ্য থেকে বছরে ১৩১৪৯০৮.৯১ মেট্রিকটন জৈবসার উৎপাদন করা সম্ভব। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এই দুই বিজ্ঞানী বলেন, দেশে প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে এই প্ল্যান্ট তৈরি করা যায়। সবস্থান থেকে গৃহস্থালীর বর্জ্য সহজেই সংগ্রহ করা যায়। একবারে ১০০ টন বর্জ্যশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্লান্ট তৈরিতে খরচ হবে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। রাজধানীর প্রতিদিনের সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিকটন বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করতে এমন দু’টি প্ল্যান্টই যথেষ্ট।প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে আট মাসের মধ্যে ব্যয় পুষিয়ে নেওয়া যাবে। গবেষক এইচ এম রঞ্জু ও পীযুষ দত্ত আরো বলেন, আমরা প্রথমে ছোট আকারে একটি প্ল্যান্ট তৈরি করি। পরে আরেকটু বড় করে উৎপাদন শুরু করেছি।পাড়া মহল্লা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে আমাদের উদ্ভাবিত প্ল্যান্টে গ্যাস ও জ্বালানি তেল উৎপাদন করছি।প্লান্টে তেলের জন্য কাঁচামাল হিসেবে প্রতিকেজি প্লাস্টিক ১৫ টাকা দরে সংগ্রহ করা হচ্ছে। এক কেজি প্লাস্টিক থেকে ৬০০-৭০০ গ্রাম তেল উৎপাদন হয়। প্ল্যান্টের অন্যান্য উপাদানসহ প্রতি কেজিতে খরচ ৩৫ টাকা এবং প্রতিলিটার বিক্রি করা যায় ৭০-৭৫ টাকায়। এ ছাড়া বর্জ্য দিয়ে বায়ো ফুয়েল, ড্রাই আইস এবং জৈবসারও উৎপাদন হচ্ছে কম খরচে।
তারা জানান এই প্ল্যান্ট তৈরির ৬০ শতাংশ অর্থ তাদের পরিবার ও ব্যক্তিগত ঋণ থেকে এসেছে। বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ বহন করেছে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান।প্ল্যান্টে উৎপাদিত তেল এবং গ্যাসের কিছু অংশ আবার প্ল্যান্টের কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা আরও জানান, প্ল্যান্টে উৎপাদিত জৈবসার,বায়োফুয়েল ও অ্যাকটিভেটেড কার্বনসহ বাকি পদার্থ এখন তাদের রিজার্ভে আছে। উৎপাদিত এসব পেট্রোলিয়াম পদার্থ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) পরীক্ষায় সন্তোষজনক দেখা গেছে। উৎপাদন আরও বাড়াতে পারলে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবেন বলেও জানান এই দুই উদ্ভাবক। প্লান্টটির কাজ সম্পর্কে তারা জানান, প্ল্যান্টটি অটোমেটিক সিস্টেমে কাজ করছে। এতে কিছু বায়োকেমিক্যাল ও কেমিক্যাল এর সঙ্গে থারমাল প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে বর্জ্য থেকে জৈবসার, ড্রাই আইস ও অন্যান্য দ্রব্য বের করে আনা হচ্ছে। সমপ্রতি প্ল্যান্টটি পরিদর্শন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. সাজিদুল ইসলাম। তিনি প্ল্যান্টে উৎপাদিত প্রতিটি পদার্থের টেস্ট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দুই গবেষক জানান, এখন দেশে অনেক বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট রয়েছে। তাদেরটাকে ঠিক ওই ধরনের বায়োগ্যাস বলা যাবে না। তবে তাদেরটা আরও বেশি পরিবেশবান্ধব। তারা জানান যদি কেউ এই প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন করতে চায় তবে তারা তাদেরকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে আগ্রহী। তারা চান এই প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে যাক। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তাদের এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। এটাই তাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক