বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে

| শনিবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৯:০৪ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী নদীতে ক্রমশ দূষণ ও দখল বেড়ে চলেছে। দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা এই নদীর দুই পাড়ে নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। যার মধ্যে আছে শিল্পকারখানা, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া প্রতিদিনই নদীতে পড়ছে টনে টনে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য। যা নদী ভরাটের পাশাপাশি দূষিত করে তুলছে। এই নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত। গত ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে ‘কয়েকদিনেই ভরাট হয়ে যায় চাক্তাই খালের মুখ, শহরের ময়লা গিয়ে পড়ে কর্ণফুলীতে’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, শহরের ময়লা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প সম্পন্ন হলেও শহরের ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে নদী। বিশেষ করে চাক্তাই খালের মুখের ময়লা সরাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধুমাত্র খালের মুখের নদী ভরাট ঠেকাতে একটা ড্রেজার মোতায়েন করতে হয়েছে। বিপুল ব্যয়ে খাল সচল রাখার তৎপরতার মাঝেও ভাটার সময় খালের তলা দেখা যাচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, শহর থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পলিথিনসহ নানা বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত এলাকায় ৮টি খাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ও আবর্জনা কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। শহরের এই বর্জ্য শুধু কর্ণফুলী ভরাটই নয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বড় ধরনের হ্যাডেক হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫ টন পলিথিনসহ বিপুল পরিমাণ ময়লা আবর্জনা অপসারণের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীতে বহুল প্রত্যাশার ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। ২০১১ সালে মালয়েশিয়ার মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন নামের কোম্পানির মাধ্যমে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প শুরু করা হলেও মাঝপথে তারা পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ডিপিএম পদ্ধতিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে চীনের বিশ্বখ্যাত কোম্পানি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে দিয়ে নতুন করে ড্রেজিং কাজ শুরু করা হয়। ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ নামের এই প্রকল্পের আওতায় নদী থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ৩শ’ কোটিরও বেশি টাকা। প্রকল্পের আওতায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গত নভেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ড্রেজিং এর সুফল ধরে রাখার জন্য বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালানো হচ্ছে। ড্রেজিং পরবর্তী তিন বছরের রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি প্রকল্পের আওতায় রয়েছে।

কিন্তু এই রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চালাতে গিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের মাথার ঘাম পায়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে। শহর থেকে বিপুল পরিমাণ ময়লা আবর্জনা নিয়মিত নদীতে গিয়ে পড়ায় চাক্তাই খালের মুখে নতুন করে ভরাট হতে শুরু করেছে। ভরাটের মাত্রা এত তীব্র যে মাত্র কয়েকদিনেই খালের মুখ ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে পরিবেশ দূষণ ও বিরূপ প্রভাব নিয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) করা এক গবেষণা প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত এতে নেতৃত্ব দেন। তাকে সহযোগিতা করেন পুরাকৌশল বিভাগের দুই শিক্ষার্থী পিয়াল বড়ুয়া ও আল আমিন। গবেষণা দলের সদস্য পিয়াল বড়ুয়া বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন তিন হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থাৎ ২৪৯ টন হচ্ছে প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় বর্জ্য, যা কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। নদীতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নদীর তলদেশে কিংবা অন্যান্য স্তরে ভাসতে থাকা এসব প্লাস্টিক বর্জ্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এসব মাছ খাদ্য হিসেবে মানুষ গ্রহণ করায় মানবদেহে মিশে যাচ্ছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মাইক্রোপ্লাস্টিক। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল সরোয়ার তাঁর এক লেখায় বলেন, বাংলাদেশের শহর এলাকায় এখনো পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় টেকসই নগর পরিবেশ নিশ্চিত করা বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের অগ্রগতির ফলে অভিগমন ও প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশে নগরের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে বর্জ্যের পরিমাণও ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। নগর পরিবেশের এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বর্তমানে একটি মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত। এজন্য সব পর্যায় থেকে সুস্পষ্ট দায়িত্ব নিয়ে সচেতন ও সুরক্ষিত অবস্থায় সমন্বয়ের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে