এটি সর্বজনবিদিত যে, পরিবেশ বলতে সাধারণত মানুষের সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়ায় উদ্রেক তৈরির ক্ষেত্রে বাহ্যিক সামগ্রিক প্রপঞ্চকে বুঝিয়ে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার’র ভাষায়, আমাদের জৈব দেহটাই আমরা এবং আমাদের জৈব দেহের বাইরের বিষয়টাই পরিবেশ। প্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক এবং সামাজিক–সাংস্কৃতিক পরিবেশের সমন্বিত উপাদান আমাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে শুধু প্রভাবিত করে না; প্রকৃত মানব সন্তান হিসেবে আমাদের সকল প্রকার ভূমিকাকে উদ্ভাসিত করে। বিশ্বসহ দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন; দেশ–স্থান–কাল ভেদে পরিবেশ দূষণ রোধে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভূমিকা অপরিসীম। সঠিক উপায় নির্ধারণে ব্যত্যয় ঘটলে কালক্রমে পরিবেশ অসহনীয় পর্যায়ে নিপতিত হয়। উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশসমূহে পর্যাপ্ত অর্থ–প্রযুক্তি–লোকবলের যোগান বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে অতিশয় দুর্বল–বিপর্যস্ত করে তুলে। পরিবেশ সুরক্ষায় মূলতঃ সক্ষমতার উল্লেখ্য অভাব প্রধান অন্তরায় হিসেবে সমধিক বিবেচ্য। নগর–শহর–প্রান্তিক পর্যায়ে যথার্থ অর্থে বর্জ্য সংগ্রহ–অপসারণ–সংরক্ষণ এবং যথোপযুক্ত পুনঃচক্রায়নের পদক্ষেপ গ্রহণে যে কোনো শিথিলতা পুরো জাতিরাষ্ট্রে দূষণ বলয় নির্মাণ করে।
জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বর্জ্য ও ই–বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে একটি মারাত্মক সমস্যারূপে চিহ্নিত। দ্রুত নগরায়ন, বিক্ষিপ্ত শিল্পায়ন, বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে বহু ধরনের বর্জ্যের উন্মুক্ত আশ্রয়স্থল হয় সরকারি বা বেসরকারি খোলা জায়গা, রাস্তার দু’পাশ অথবা নদী–নালা–জলাশয়–খাল–বিল ইত্যাদি। ফলে দেশজুড়ে নিম্নাঞ্চল, জলাভূমি ও পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা চরম অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির সম্মুখীন। গবেষণার ফলাফল অনুসারে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে ১৯৯১ ও ২০০৪ সালে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদিত হতো যথাক্রমে ৯ হাজার ৮৭৩ ও ১৬ হাজার ৩৮২ টন এবং মাথাপিছু বর্জ্য সৃষ্টির পরিমাণ ছিল ১৫০টন। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ মহানগরী। জীবন–জীবিকার তাগিদে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হওয়ায় ঢাকার জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানব সৃষ্ট আবর্জনা। সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশের মোট বর্জ্যের শতকরা ৩৭ শতাংশই উৎপাদিত হয় রাজধানী ঢাকায়। ইউএনএফপিএ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম প্রধান দূষিত শহর এবং শহুরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এর একটি বড় সমস্যা।
দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল শহর বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামেও অপরিকল্পিত নগরায়ণে বিক্ষিপ্তভাবে শিল্পকারখানা–ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি গড়ে উঠার সাথে বেড়েছে বর্জ্যের আধিক্য। সমীক্ষা অনুসারে দেশের মোট বর্জ্যের শতকরা প্রায় ২১ শতাংশ উৎপাদিত হয় চট্টগ্রামে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় অধিকসংখ্যক মানুষের গৃহস্থালির বর্জ্য প্রতিদিন যত্রতত্র ফেলে স্তুপ করে রাখা হয় এবং তা পচে–গলে চারপাশের পরিবেশকে দুঃসহ দূষণে পর্যুদস্ত করে। বর্ষাকালে ডাস্টবিন উপচে বর্জ্যগুলো ড্রেনে পড়ে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ পুরো ড্রেনেজ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার রূপ পরিগ্রহ করে। ২০১৯–২০ সালে চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে প্রতিদিন ৩ হাজার টন উৎপাদিত বর্জ্যের ২ হাজার টন সিটি কর্পোরেশন সংগ্রহ করলেও বাকী ১ হাজার টন বর্জ্য নালা–নর্দমা, খাল–বিল, নদী ও উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিবর্তে পরিচ্ছন্নতা বিভাগের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণের কাজ চললেও পরিবহন ও অপসারণের কাজ পরিবেশ সম্মত নয় বলে তাদের দাবি। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগরের ৫০ লাখ মানুষ প্রতিদিন ৬০০ গ্রাম করে বর্জ্য উৎপাদন করে। যার মধ্যে ১ হাজার ৮৩০ টন গৃহস্থালি, ৫১০ টন সড়ক ও অবকাঠামোগত এবং ৬৬০ টন মেডিকেল বর্জ্য।
আমরা সকলেই সম্যক অবগত; প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়কালে ইলেকট্রনিকস পণ্য সামগ্রীর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসব পণ্যের পরিত্যক্ত অংশ বা ই–বর্জ্য। দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মেবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশনার, ফটোকটি মেশিনসহ নানান ইলেকট্রনিক সামগ্রী নষ্ট হয়। কিন্তু ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের পরিবেশসম্মত ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় সেগুলো অন্যান্য গৃহস্থালি ময়লা–আবর্জনার সঙ্গে ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী ই–বর্জ্য অতিমাত্রায় উদ্বেগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জাতিসংঘের গ্লোবাল ই–ওয়েস্ট মনিটর ২০২৪ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বে প্রায় ৬২ মিলিয়ন টন ই–বর্জ্য তৈরি হয়েছে যা পরিবহন করতে প্রয়োজন হতো ১ কোটি ১৫ লাখ ট্রাক। সংস্থাটির মতে, বিশ্বে প্রতি পাঁচ বছরে ই–বর্জ্য ২১ শতাংশ হারে বাড়ছে। ই–বর্জ্য সবচেয়ে বেশি জমা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে।
বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের অর্থায়নে পরিবেশ ও সম্পদ ব্যবস্থাপন এবং বুয়েট কর্তৃক ২০১৮ সালে পরিচালিত সমীক্ষা মতে, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ই–বর্জ্যের আনুমানিক পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩ লাখ ১০ হাজার ও ৪ লাখ টন। প্রতি বছর ই–বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে ৩০ শতাংশ করে যা ২০৩৫ সালে গিয়ে পৌঁছাবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টনে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ই–বর্জ্য উৎপাদিত হয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। এটি দেশে উৎপাদিত মোট ই–বর্জ্যের ৮০ শতাংশ। বাকী ২০ শতাংশ উৎপাদিত হচ্ছে মোবাইল, ল্যাপটপ, ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি পণ্য থেকে। বিভিন্ন দেশ থেকে ভাঙার জন্য আনা পুরোনো জাহাজগুলোতে সেসব দেশের ই–পণ্য বা ইলেকট্রনিক বর্জ্য বিদ্যমান থাকে। জাহাজ ভাঙার সময় এবং তৎপরবর্তীতে এসব বিষাক্ত ই–বর্জ্য মাটি ও পানিতে মিশে চক্রাকারে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার টন ই–বর্জ্য তৈরি হলেও রিসাইক্লিং হয় মাত্র ১৩ হাজার ৩০০ টন। ফলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য অব্যবস্থাপিত থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের মধ্যে সিসা, সিলিকন, টিন, ক্যাডমিয়াম, পারদ, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি রাসায়নিক থাকে যেগুলো দেশের মাটি ও পানিকে দূষিত করছে। নানাভাবে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগের বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ই–বর্জ্যের কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম নেওয়া, ওজন কম হওয়া এবং মৃত শিশু জন্মের ঘটনাও ঘটছে। ই–বর্জ্যের সিসা নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। শিশু বড় হলে শ্বাসতন্ত্র, থাইরয়েড জটিলতা, ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মতো বড় রোগের জটিলতাও দেখা দিতে পারে। ১৫ জুন ২০২১ প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক প্রতিবেদনে ই–বর্জ্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশু, কিশোর–কিশোরী এবং গর্ভবতী মায়েদের কার্যকর ও বাধ্যতামূলকভাবে রক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালককে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, পৃথিবীজুড়ে ‘ই–বর্জ্যের সুনামি’ চলছে। মানুষের জীবন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ছে। একই সাথে প্লাস্টিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের বিপরীতে সমুদ্র এবং তার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সারা বিশ্ব সরব। সংস্থাটির হিসাবে, বিশ্বের ১ কোটি ২৯ লাখ নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য খাতে নিয়োজিত। এ সংখ্যক নারী ও তাদের অনাগত সন্তানদের বিষাক্ত ই–বর্জ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ শিশু–কিশোরের একটা বড় অংশের বয়স পাঁচ বছরের নিচে, যারা সক্রিয়ভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের সঙ্গে জড়িত।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য শহরে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে এখনও প্রায় সনাতন পদ্ধতিতেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যদিও দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে প্রয়োজনীয়তা–আবশ্যকতা বিবেচনায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন আকারে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা–২০২১ জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের ২৮টি দায়িত্বের উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল; বর্জ্য হ্রাস–পুর্নব্যবহার ও পুনঃচক্রায়নসহ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জাতীয় কৌশল এবং নির্দেশনা অনুসরণ, কঠিন বর্জ্য পৃথকভাবে সংগ্রহপূর্বক যথাযথভাবে আবৃত করে সরাসরি চূড়ান্ত পরিশোধনস্থলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ, চিকিৎসা বর্জ্য বিধিমালা ২০০৮ এর বিধান অনুসরণ এবং পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বর্জ্যকে জ্বালানিতে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি। এছাড়াও বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ সাইটে গন্ধ ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, পুনঃচক্রায়নযোগ্য কিন্তু উচ্চ ক্যালোরিফিক বর্জ্য আলাদা করে ওয়েন্ট টু এনার্জি প্ল্যান্ট বা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কো–প্রসেসিং বা তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবহার, স্যানিটারি ল্যান্ডফিল্ড করা এবং এর পরিবেশ দূষণে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণে ৮টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বহুকাল যাবৎ এ বিষয়ে নানান নির্দেশনা প্রচার করে আসলেও তা শুধু বাচনিক আলাপ–আলোচনায় সীমাবদ্ধ। প্রায়োগিক কর্মকৌশলে এর প্রতিফলন কতটুকু দৃশ্যমান; তা গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। যদি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক উদ্যোগ গ্রহণ এবং কার্যকর করার ব্যবস্থা করা না হয়, জাতিরাষ্ট্র অদূর ভবিষ্যতে এক কঠিন পরিবেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী