জুলাই–আগস্ট ছাত্র–জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার। এই সরকারে বন ও পরিবেশ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মত দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন আরেক বিখ্যাতজন, পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের নিরলস যোদ্ধা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি বেলা দেশের নদ–নদী, খাল–বিল–জলাশয়, পাহাড়–টিলা–বন রক্ষাসহ পরিবেশ বিধ্বংসী যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মাঠে–ময়দানে যেমন সক্রিয়, তেমনি আইনি লড়াইয়েও সচেষ্ট থেকে সারাদেশে মানুষের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। আজকের লেখায় প্রিয় ব্যক্তিত্ব সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাছে দুটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করছি, যা তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন।
১. চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কাটগড় গ্রামে ( দোহাজারী নামে প্রচারিত) সাড়ে এগার একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীনতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাঙ্গুভ্যালি টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগ ভবনের বিপরীতে এই কারখানাটি ১৯৬২ সালে নির্মাণ কাজ শেষ করে ১৯৬৩ সালে উৎপাদনে যায়। তৎকালীন পাকিস্তানে বাইশ পরিবারের একটি ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠী এটি প্রতিষ্ঠা করে। এটি আমার নিজ গ্রামে। এই কারখানার জন্যে তৎকালীন সরকার প্রয়োজনীয় জমি হুকুম দখল করে ইস্পাহানি গ্রুপকে বুঝিয়ে দেয়। সাড়ে এগার একর জমির মধ্যে ৭০ ভাগই ছিল আমাদের বংশের, বাপ–চাচাদের। কানি ( ৪০ শতক) জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সাত‘শ টাকা। সরকারি দপ্তর থেকে সে টাকা তুলতে জুতা–স্যাণ্ডেলের তলা খুয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা আখেরে কানিপ্রতি ৪‘শ টাকাও হাতে পাননি। তারপরও কারো কোনো আক্ষেপ ছিল না এই জন্যে যে – এলাকায় একটি শিল্প কারখানা হচ্ছে। এই কারখানায় মানসম্পন্ন প্লাইউড, টি–চেস্ট ( চা পাতার বাক্স), ক্যারম বোর্ড, ফ্লাশডোর উৎপাদিত হত।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে কারখানাটি জাতীয়করণ করা হয় এবং এটি বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনে ( বিএফআইডিসি) আসে। কারখানাটি সবসময় লাভজনক ছিল। তারপরও ২০০৩ সালে সরকার এই কারখানাটি বিরাষ্ট্রীকরণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা দ্রুত কার্যকর করে। শেখ আনোয়ার হোসেন নামে একজন আমেরিকা প্রবাসীর কাছে মাত্র সাড়ে ছয় কোটি টাকা দামে সাঙ্গুভ্যালি টিম্বার ইণ্ডাস্ট্রিজ বিক্রি করা হয়। শর্ত ছিল কারখানা দ্রুততম সময়ে চালু করা হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও ক্ষোভের সাথে বলতে হচ্ছে, দীর্ঘ ২১ টি বছর পার হতে চলল সাঙ্গুভ্যালি বন্ধ। আমেরিকা নিবাসী মালিকের পক্ষে একজন কেয়ারটেকার সেখানে আছেন। নতুন মালিক কারখানাটি কেনার পর জার্মানির তৈরি মূল্যবান সব মেশিনারিজ বিক্রি করে দেন। পুলিশ ও স্থানীয় কিছু লোকজনকে হাত করে পর্যায়ক্রমে সব মেশিনারিজ রাতের আঁধারে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয়। সব গাছপালা বিক্রি করে দেয়া হয়। কারখানার বহু বিভাগের ইট–লোহা পর্যন্ত খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কারখানা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই এখানে আর অবশিষ্ট রাখা হয়নি। পুরো কারখানার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন ঘন জঙ্গলে ভরা, সাপ ও বিষাক্ত পোকা–মাকরে গা ছমছম করা একটা ভূতুড়ে পরিবেশ।
মেশিনারিজ ও গাছপালা বিক্রি করে আমেরিকা প্রবাসী তার ক্রয়মূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। চারদিকে বাউন্ডারি দেয়া সাড়ে এগার একর জায়গা এখন উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দিয়ে তিনি সটকে পড়ার তালে আছেন।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে সাঙ্গু ব্রিজ পার হলেই আমাদের গ্রাম কাটগড়, কালিয়াইশ ইউনিয়ন। যেখানে এই কারখানা, চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগ, পিডিবির ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাবস্টেশন, বিতরণ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলীর কার্যালয়।
এছাড়া ছোট–বড় অর্ধশতের মত রাইস মিল, লাকড়ি মিল, স‘মিল, ডজনখানেক ইটভাটা ও অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাঙ্গুভ্যালি যখন চালু ছিল তিন শিফটে উৎপাদন চলত। শত শত শ্রমিক কারখানায় কাজ করত। শ্রমিক– কর্মচারীদের কলোনি ছিল। তিন শিফটে ছুটি– বিরতিতে সাইরেনের শব্দে মানুষ সময়ের নির্ণয় করত। পুরো এলাকা রাতদিন ছিল একটি ব্যস্ততম গঞ্জ। সাঙ্গুভ্যালি বন্ধ থাকায় এখন নেই আগের সেই কোলাহল। বহু মানুষের কর্মসংস্থানের পথ হয়েছে রুদ্ধ।
যে বেসরকারি মালিক মিলটি কিনেছিলেন পদে পদে তিনি শর্ত ভঙ্গ করেছেন। ১৯৬০/৬১ সালে সরকার জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন এই শর্তে যে, যে কাজে অধিগ্রহণ সে কাজে ব্যবহৃত না হলে জমি এর মূল মালিকদের ফেরত দিতে হবে। বিদ্যমান আইনও তা বলে। কিন্তু ভূমি মালিকদের একজন হিসেবে বলছি, এলাকার কেউ সেই দাবি করছেন না। এলাকাবাসী চান সরকার আশু হস্তক্ষেপ করে আমেরিকা প্রবাসীর কাছ থেকে সাঙ্গুভ্যালি টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিজ ফেরত নিয়ে আবার নতুন করে কারখানা চালুর উদ্যোগ নিক। কারখানায় আবার ফিরুক কোলাহল। সাইরেনের শব্দ ছড়িয়ে পড়ুক পাঁচ–দশ গ্রাম। কারখানা চালু হলে গঞ্জের ঝিমিয়ে পড়া ভাব কাটবে, নতুন কর্মসংস্থান হবে– প্রত্যাশা এতটুকুই।
২. চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন ছিল সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। ভোর থেকে রাত অব্দি উভয়দিক থেকে সাত জোড়া ট্রেন চলত। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি এই ট্রেনের আসা–যাওয়া। রাতের ট্রেনগুলি এসে এর ইঞ্জিন যখন সান্টিং করতে সাঙ্গু তীর পর্যন্ত যেত তখন এর হেডলাইটের তীব্র আলোয় আমাদের উঠোন এমন আলোকিত হয়ে পড়ত যে মাটিতে সূঁচ পড়লে তাও খুঁজে পাওয়া যেত। কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রসঙ্গ তাই আমাদের নস্টালজিক করে তোলে। এই রেললাইন এখন সম্প্রসারিত হয়েছে কক্সবাজার পর্যন্ত। নতুন লাইনটি শুরু হয়েছে সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ ইউনিয়নের কাটগড় গ্রাম থেকে। সাঙ্গু নদের দক্ষিণ তীরে আমাদের গ্রামকে দ্বিখণ্ডিত করে চলে যাওয়া এই রেললাইন এমন অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে তার ফল কী ভয়ানক হতে পারে তা ২০২৩ সালের ভায়াবহ বন্যা চাক্ষুষ দেখিয়ে দিয়ে গেছে। রেললাইনে নদ তীরবর্তী তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কালভার্ট রাখা হয়নি। সাঙ্গু নদের পানি কূল ছাপিয়ে যখন লোকালয়ে উপচে পড়ে তখন রেললাইনের কারণে তা প্রবাহিত হতে পারে না। পূর্ব পাশের গ্রামসমূহ কোমর থেকে গলা পর্যন্ত তলিয়ে যায় পানির নিচে। অনেক জায়গায় বাড়ির চালা পর্যন্ত ডুবে গেছে। এটা এখন নিয়তি হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটা উপায় হচ্ছে কাটগড় গ্রামে যেখান থেকে নতুন রেললাইন শুরু হয়েছে সেখান থেকে সাঙ্গু নদের তীর ঘেঁষে অন্তত পাঁচফুট উঁচু করে একটি বেড়িবাঁধ ধর্মপুরের আলমগীর গ্রাম হয়ে কুণ্ডুকূল পর্যন্ত নির্মাণ করা। এটা হলে নদের কূল ফেটে রেললাইনের পূর্বদিকের গ্রামগুলি চাল পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে যাবে না। যেখানে বলছি, সেখানে নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষায় পাথরের স্পার দেওয়া আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই স্পার মেরামতের অভাবে বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে বা বন্যায় ধসে পড়েছে। পুরাতন এই স্পার চলতি শুকনো মৌসুমে জরুরি মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে। এর উপর দিয়ে যে বেড়িবাঁধটির প্রস্তাব করছি তা একইসাথে সড়ক হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিলে কালিয়াইশ, ধর্মপুর, বাজালিয়া ও পুরানগড় ইউনিয়নের কয়েকলাখ মানুষের চলাচল সুবিধা সহজ হবে। আবার বান্দরবানে আসা যাওয়ার বিকল্প পথ হিসেবেও এটি ব্যবহার করা যাবে। কালিয়াইশসহ আশপাশের এসব এলাকার মানুষ সাঙ্গুর ক্রমাগত ভাঙ্গনে জমি–জিরাত হারিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন, অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। এলাকার রাস্তাঘাট নদগর্ভে বিলীন হওয়ায় বহু এলাকায় চলাচলের পথটুকুও নেই। প্রস্তাবিত বেড়িবাঁধ কাম সড়কটি হলে কয়েকলাখ মানুষ চলাচলের ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবে।
যে দুটি বিষয় নিয়ে লিখলাম তার একটি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের, অন্যটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন। দুটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাই খুব আশাবাদী হয়ে মাননীয় উপদেষ্টার কাছে লিখলাম ইতিবাচক সাড়ার প্রত্যাশায়।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।