চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। পানি কমার সাথে সাথে সড়কের ক্ষতি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক সড়ক যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়।
হাটহাজারীতে বন্যার পানি নামছে ধীরলয়ে। বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হয়েছে। তবে অনেক এলাকায় সড়ক এখনো পানির নিচে। এছাড়া কৃষিতে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। ভুক্তভোগীরা হালদার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের দাবি জানিয়েছেন।
আর মীরসরাইয়ে কয়েকটি এলাকায় পানি কমে এসেছে। কিন্তু উপজেলার মধ্যবর্তী এলাকার গ্রামগুলো থেকে পানি কমছে ধীরগতিতে। যেসব এলাকা মানুষ ঘর ছাড়েননি, তাদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ফটিকছড়িতে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি : ফটিকছড়ি প্রতিনিধি জানান, ফটিকছড়িতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। বন্যায় উপজেলার অনেক সড়ক তলিয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে যেসব সড়ক থেকে পানি সরে গেছে, সেখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। এগুলোর কোনোটি ভেঙে গেছে, কোনোটিতে ছোট–বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক দিয়ে যানবাহন ও মানুষ চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দ্রুত সময়ে সড়কগুলো মেরামত করে যান চলাচলের উপযোগী করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
উপজেলার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রাম–খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কের নাজিরহাট এলাকায় দুটি স্থানে সড়কের পশ্চিম পাশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এতে দুই স্থানে সড়ক ভেঙে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। একই চিত্র পাইন্দং–বারৈয়ারঢালা সড়কে। নয়াহাট বাজারের পূর্ব পাশে সড়ক ভেঙে এক পাশের ইট–কংক্রিট সরে গেছে।
খিরামেও সড়কে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মধ্যম খিরাম বহরম পাড়া–নুর নগর পাড়, দক্ষিণ খিরাম হচ্চারঘাট সড়ক, উত্তর খিরাম মগকাট সড়কে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় সড়কের ইট–বালি পুরোপুরি সরে গেছে। এছাড়া গ্রামীণ ও আঞ্চলিক সড়কসহ বিভিন্ন সড়কের উপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে ভেঙে গেছে। কোথাও পানির স্রোতে সড়ক বিলীন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক সড়ক যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক বন্যায় ফটিকছড়িতে এলজিইডির ৮১টি সম্পূর্ণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ১৮টি সেতু ও ১৩৬টি কালভার্ট সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখনো পুরোপুরি হিসাব পাওয়া যায়নি। কারণ বিভিন্ন জায়গায় সড়কে এখনো পানি রয়েছে। সুন্দরপুর, হারুয়ালছড়ি, নাজিরহাট পৌরসভা, সুয়াবিল, দাঁতমারা ও ভূজপুরে সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী তন্ময় নাথ বলেন, পুরোপুরি ক্ষতি এখনো বোঝা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় চলমান বন্যায় চট্টগ্রাম–খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ক্ষত স্বল্পমেয়াদী ঠিক করতে ৩০ লাখ এবং দীর্ঘমেয়াদী ঠিক করতে আড়াই কোটি টাকার প্রয়োজন আছে। এছাড়া সেতু ও কালভার্ট কিছু কিছু স্থানে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাব–ডিভিশনাল প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, কিছু ক্ষতি চিহ্নিত করা গেলেও সম্পূর্ণভাবে পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ সঠিক জানা যাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রতিটি এলাকার ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা হচ্ছে। স্ব স্ব বিভাগের কর্মকর্তরা তালিকা করছেন। পানি পুরোপুরি কমে গেলে এসব এলাকায় কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
হাটহাজারীতে পানি নামছে ধীরলয়ে : হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, হাটহাজারীর ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় বন্যা পরিস্থিতির ক্রমে উন্নতি হচ্ছে। তবে বন্যার পানি নামছে ধীরলয়ে। হালদা নদীতে জোয়ার সময় উপজেলার আওতাধীন অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় বানের পানি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। গত শনিবার বিকাল থেকে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। প্রবল বর্ষণ না থাকায় হালদা নদীতে ঢলের প্রকোপ তেমন নেই। হালদা নদীর উপরের অংশে বৃষ্টিপাত বেশি হলে নদীতে ঢলের প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। এ সময় নদীর নাজিরহাট ছালে আহাম্মদ দফাদার বাড়ি এলাকায় বাঁধের বিধ্বস্ত অংশ দিয়ে পুনরায় ঢলের পানি ঢুকে আবারো বন্যার সৃষ্টি হবে। তাই এলাকাবাসীর দাবি, অবিলম্বে হালদা নদীর বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামতের। নদীর এই অংশের ভাঙনের কারণে উপজেলার ১ নং ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন ৬টি ওয়ার্ডে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলম শওকতের তথ্যমতে, হালদার এই অংশে বেড়িবাঁধের ভাঙনে ৩ হাজার বসতঘরের ২৫/৩০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। যেসব পরিবারের দ্বিতল, ত্রিতল ভবন রয়েছে তারা ভবনের উপরে আশ্রয় নেন। গতকাল ঘরে পানি কমে গেলে পরিবারগুলো গৃহস্থালী জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে।
বাড়িঘরে পানি ঢোকায় লাকরির চুলা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয়রা রান্নার জন্য গ্যাসের চুলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এই কারণে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিলিন্ডারের দাম বিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোথাও কোথাও সিলিন্ডারের সংকটও দেখা দিয়েছে। বন্যার কারণে গাড়ি আসতে না পারায় এই সংকট বলে জানান বিক্রেতারা।
বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও নাজিরহাট মন্দাকিনী সড়ক, হুর পাড়া সড়ক, চাঁন গাজী সড়ক, ইউছুফিয়া সড়ক, বংশাল সড়ক, সৈয়দ কোম্পানি সড়ক, ধলই কাজী পাড়া সড়ক, কাটিরহাট–যুগীরহাট সড়ক, ধলই–গুমানমর্দন সড়ক, গুমানমর্দন ডিসি সড়ক, মুৎসুদ্দি পাড়া সড়ক, মাস্টার পাড়া সড়ক, হাজী ইউসুফ সড়ক, চারিয়া মুরাদ সড়ক, মীরেরহাট মোহাম্মদপুর সড়ক, নূর মোহাম্মদ সড়ক, ইছাপুর চাঁনগাজী সড়ক, মুফতি ফয়েজুল্লা সড়ক, সুবেদার পুকুর পাড় পুন্ডরিক সড়কসহ বেশ কিছু গ্রামীণ সড়ক এখনো পানির নিচে। ফলে ওইসব সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে।
আল–জামিয়াতুল ইসলামিয়া হামিয়ুচ্ছুন্নাহ মেখল মাদ্রাসায় অবস্থানকারী সহস্রাধিক শিক্ষার্থী পানিবন্দি হয়ে মানবেতর অবস্থায় করছে। গড়দুয়ারা, মেখল, উত্তর ও দক্ষিণ মাদার্শা, গুমানমর্দন, ছিপাতলী, নাঙলমোড়া, শিকারপুর, বুড়িশ্চর, মির্জাপুরের পূর্ব পাশ, শিকারপুর, উত্তর ও দক্ষিণ মাদার্শা, বুড়িশ্চর ইউনিয়ন, ফতেপুরের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের কিছু অংশ শুরু থেকে পানিবন্দি আছে। এসব এলাকায় জোয়ারে পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে হালদা নদীর সংযোগস্থল চেংখালী খালের স্লুইচ গেট বিধ্বস্ত হওয়ায় জোয়ারের পানি দ্রুত লোকালয়ে ঢুকে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।
হাটহাজারীতে বন্যায় ৩ হাজার ২শ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্যমতে, উপজেলা ছিপাতলী দুটি শেডের ৩ হাজার মুরগির খামার, ফরহাদাবাদ, ধলই, মেখল, গড়দুয়ারায় ৩০ টন খড় নষ্ট হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আল মামুন সিকদার বলেন, উপজেলা ১৪টি ইউনিয়নে বন্যার পানিতে আবাদি জমি তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। গতকাল সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আনুমানিক ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
বন্যার শুরুর দিকে জেলা প্রশাসন থেকে ১৫ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ পাওয়া যায়। এরপর আর কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।
গুমানমর্দন ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবু তৈয়ব বলেন, এই ইউনিয়নে জেলা প্রশাসনের বরাদ্দের ৫শ কেজি খাদ্যশস্য পাওয়া গেলেও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বরাদ্দের ডিও ছাড় করে আনা সম্ভব হয়নি।
কয়েকটি এলাকায় পানি কমেছে : মীরসরাই প্রতিনিধি জানান, মীরসরাইয়ে গতকাল বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। শুক্রবার থেকেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সবাই খাবার দিচ্ছে। কিন্তু দুর্গম এলাকায় অনেকে ঘর ছাড়েননি। তাদের অনেকে খাবার পাচ্ছেন না। কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, ধূম, নাহেরপুর, বাংলাবাজার, মোবারকঘোনা, কাটাগাং, খৈয়াছরা, মায়ানী, মঘাদিয়া, ইছাখালীতে অনেক বন্যার্ত কষ্টে আছেন।
ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে আসায় করেরহাটসহ কয়েকটি এলাকায় পানি কমে এসেছে। কিন্তু উপজেলার মধ্যবর্তী এলাকার গ্রামগুলো থেকে পানি কমছে ধীরগতিতে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও অনেকে নিজের বাড়িঘর ছাড়েননি। কেউ কেউ ছাদে, সিঁড়িতে বা অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক বাড়িতে খাবার পৌঁছায়নি। উপজেলার সকল আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত খাবার, পানি থাকলেও যারা ঘর ছাড়েননি তারা মানবেতর অবস্থায় আছেন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেও পর্যাপ্ত খাবার দিতে পারছেন না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর দিকেও নজর দেওয়া উচিত।
মীরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন বলেন, বিভিন্ন এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে বন্যা পরবর্তী সংকট ও স্বাস্থ্যসেবা মোকাবেলায় উদ্যোগ গ্রহণ করছি। তিনি জানান, উপজেলার মস্তাননগর জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় একটি স্বাস্থ্য ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।