বন্যপ্রাণী পাচারের নিরাপদ রুট চট্টগ্রাম

যত বেশি বিরল দাম তত বেশি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করছে সংঘবদ্ধ চক্র

ঋত্বিক নয়ন | সোমবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ at ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামসহ আশেপাশের পাঁচ জেলা এখন বন্যপ্রাণী পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে বন্যপ্রাণী ও পাখি পাচার করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনের (ইন্টারপোল) আগ্রহে এসব বন্যপ্রাণী উদ্ধারে তৎপর হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরও। এর মধ্যে বিরল ও বিপদাপন্ন প্রজাতির অনেক প্রাণীপাখিও রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের অভিযানে কিছু প্রাণী ও পাখি উদ্ধার হয়। তবে এতে নিয়ন্ত্রণে আসছে না বন্যপ্রাণী পাচার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের অভিযানে প্রতিনিয়তই এমন অনেক বন্যপ্রাণী ও পাখি উদ্ধার হচ্ছে। যদিও পরিবেশবাদীদের সন্দেহ, বন্যপ্রাণী পাচার কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ও আওতা যতটুকু মনে করা হচ্ছে, তার চেয়েও বড়। এ পাচার কার্যক্রম ঠেকাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বন বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা রয়েছে ঠিকই, তবে তা আরো অনেকখানি বাড়ানো প্রয়োজন।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, চট্টগ্রামে যে সব বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন গহিন এলাকা থেকে এসেছে। পাচারকারীরা চট্টগ্রামকে এখন রুট বানিয়ে পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও জরিমানাসহ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন অভিযান পরিচালনার জন্য আমরা র‌্যাব ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারাও আমাদের সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে।

তিনি আরো জানান, আমাদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগসহ বন বিভাগে লোকবল সংকট রয়েছে। তাই বিশাল বন এলাকা আমাদের পাহারা দেয়া সম্ভব হয় না। এর পরও বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান) তিন জেলার গহীন বনাঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম হয়ে পাচার হচ্ছে দুর্লভ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। বান্দরবানের আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ি ও বাঁশখালীর চুনতির গহীন অরণ্য থেকে বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীগুলো ধরে প্রথমে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া হয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। এ চট্টগ্রামই এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যপ্রাণী পাচারের বড় একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সেখান থেকে এসব প্রাণী ঢাকা বা অন্যান্য জেলা অথবা প্রতিবেশী ভারতে পাচার করে দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের নূপুর মার্কেট, দেওয়ানহাটসহ বিভিন্ন স্থানে এখন এ বন্যপ্রাণী কেনাবেচাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মূলত পাচারকারীরা এ এলাকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে বন্যপ্রাণী সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার ও ঢাকায় পাচার করে। পরে এসব বন্যপ্রাণী ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। বন্যপ্রাণীগুলো বাসায় লালনপালনের সুযোগ নেই। এসব বন্যপ্রাণী নানা হাত ঘুরে প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশে পাচার করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশ প্রশাসনের আরো তৎপরতা প্রয়োজন। তাছাড়া চট্টগ্রামে যেসব পাচারকারী আছে তাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে বন্যপ্রাণী ও পাখি পাচার করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এর মধ্যে বিপন্ন প্রজাতির অনেক পাখিও রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বন কর্মকর্তাদের অবহেলার সুযোগে পাচারকারী চক্র বন থেকে বিভিন্ন প্রাণী ধরে পাচার করছে। এ চক্রে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকজন জড়িত। সাম্প্রতিক অভিযানে গন্ধগোকুল, হগ ব্যাজার, টিয়া, ময়না, মুনিয়া, বুলবুলি, বানর, ঘুঘু, শালিক, তক্ষক, গুইসাপ, লজ্জাবতী বানর, বন্যশূকর, মেছোবিড়াল, বনরুই, প্যাঁচা ও কালিম পাখি উদ্ধার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিক্রির সময় উদ্ধার করা হয় হরিণের মাংসও।

গত ৩ নভেম্বর নগরীর বাকলিয়া থানার নতুন ব্রিজ এলাকা থেকে পাঁচটি বিলুপ্ত প্রজাতির ‘মুখপোড়া হনুমান’ উদ্ধার করেছে বাকলিয়া থানা পুলিশ। এ সময় পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ৩০ অক্টোবর একই এলাকা থেকে বিপন্ন প্রজাতির দুইটি গোর খোদককে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। দেখা গেছে, ২৪ মে বাঁশখালী থেকে বন্যপ্রাণী পাচারকালে গ্রেপ্তারকৃত অপরাধী কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের দিগরপান খালী স্কুলের পাশে মৃত আবদুল মালেকের ছেলে মো. সেলিম (৫৩) জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও বন্যপ্রাণী পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছে তিন নভেম্বর।

সিএমপির ডিসি (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সামপ্রতিক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত ও পাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন সংস্থা বৈশ্বিকভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে বিরল বন্যপ্রাণী সংগ্রহ করে বলে গ্রেপ্তারকৃতরা আমাদের জানিয়েছে। এরপর বিভিন্ন জনের হাত ধরে ভারত সীমান্ত হয়ে ইউরোপআমেরিকা পাচার হচ্ছে। তারা কম দামে বন্যপ্রাণীগুলো সংগ্রহ করে বেশি দামে বিক্রি করে থাকে। যে প্রাণী যত বেশি বিরল তত দাম বেশি। তাই লোভে পড়ে পাচারকারীরা এসব প্রাণী ধরে বিদেশে পাচার করে। পাচার চক্রে আরও যারা জড়িত তাদেরকেও গ্রেপ্তার করতে পুলিশের অভিযান চলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজ্বালাও-পোড়াও নয়, আন্দোলনের অধিকার সবার আছে : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ইউসিবি পিএলসির কম্বল বিতরণ