আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ ও প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বন্যপ্রাণীর হটস্পট হয়ে উঠেছে খাগড়াছড়ি। বিপন্ন মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান, লজ্জাবতী বানর, সাম্বার হরিণ, লাল উড়ন্ত কাঠবিড়ালী, গন্ধগোকূলসহ বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী দেখা যায় খাগড়াছড়িতে। এছাড়া ধনেশ, লাল মাথা শুনচা, এশীয় নীল পরী, খয়রা মাথা শুচমা, মালায়ন ঝুটিয়ালসহ দুর্লভ ও সুলভ অন্তত ৫ শতাধিক প্রজাতির পাখি দেখা যায় এখানে। বন বিভাগের তৎপরতায় কমেছে বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার। বন বিভাগের এমন উদ্যোগ অব্যাহত রাখার দাবি পরিবেশকর্মীদের।
সম্প্রতি খাগড়াছড়ির বন বিভাগের কার্যালয়ের পাশের চাপালিশ গাছে দেখা মিলেছে দুর্লভ মুখপোড়া হনুমানের। খাবারের সহজলভ্যতা ও শিকারীদের উৎপাত না থাকায় এই এলাকায় প্রায় দেখা যায় বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন এই প্রজাতির হনুমানের। এর আগে চলতি মৌসুমে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের কলেজ টিলা, ভাইবোন ছড়া, গঞ্জপাড়া এলাকা থেকে দুর্লভ লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করে বন বিভাগের সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করেছে বন বিভাগ। খাগড়াছড়ির মটিরাঙার কেবল পিটাছড়ার পাহাড়ি বনে আরো অন্তত ৮টি লজ্জাবতী বনে রয়েছে। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন বনে এরা ছড়িয়ে আছে। পিটাছড়ার বনে লজ্জাবতী বানর ছাড়াও রয়েছে দেশের অতি দুর্লভ পাখি লাল মাথা কুঁচকুচি। জেলার দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের বড়খাঙড়াখাইয়া বনে দেখা মিলেছে লাল উড়ন্ত কাঠবিড়ালী বা ‘ছলক’র। সামপ্রতিককালে এই বন ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের আর কোনো বনে এ প্রাণীর দেখা মেলেনি। রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, মায়া হরিণ, বন্য শুকুর। বাংলাদেশে যত প্রজাতির হরিয়াল রয়েছে, তার সবই এই প্রাকৃতিক বনে পাওয়া গেছে। সবশেষ দেখা মিলেছে গেঁজলেজ হরিয়ালের। বনে পাকড়া ধনেশ, জলপাই বুলবুল, বন মোরগ, সবুজ ঘুঘু, কালো মাথা বুলবুল, কালো মথুরা, বড় কাবাসি, পাহাড়ি ময়না, এশীয় দাগী প্যাঁচা, কমলা বুক হরিয়াল, ল্যাঞ্জা হরিয়াল, এশীয় নীল পরী, ঠোঁট মোটা হরিয়াল, ছোট হরিয়াল, নীল দাঁড়ি সুইচোরা, সিঁদুরে মৌটুসি, ইন্ডিয়ান রোলার, বন কোকিলের জাত পাওয়া গেছে। রামগড়ের লোকালয় এবং আশপাশের টিলায় দেখা যায় চশমাপরা হনুমান।
শিকার বন্ধে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি ও পাচার বন্ধে বন বিভাগের উদ্যোগের কারণে নিরাপদ হয়েছে বন্যপ্রাণীর জীবন। খাগড়াছড়ির আলুটিলা প্রাকৃতিক বন ঘেষা রিছাং ঝরনার বাসিন্দা বীর বিক্রম ত্রিপুরা ও ব্রজবাসী ত্রিপুরা বলেন, আমাদের এখানে বন বিভাগের আওতাধীন ১৭০০ একরজুড়ে সংরক্ষিত বন রয়েছে। বন বিভাগের নির্দেশনায় স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে বন বিভাগের পাশাপাশি আমরাও বন সুরক্ষায় কাজ করি। বনের মধ্যে লজ্জাবতী বানর, গুইসাপ, অজগর সাপ, বনমোরগ, গন্ধগোকূল, মেছো বিড়াল, টিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এগুলো যাতে কেউ শিকার করতে না পারে সেটা আমরা নিশ্চিত করি।
খাগড়াছড়ির পরিবেশবাদী সংগঠন পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ রাসেল বলেন, ২০১৭ সাল থেকে আমরা লজ্জাবতী বানর সংরক্ষণের কাজ করছি। এছাড়া জার্মানভিত্তিক একটি সংগঠনের উদ্যোগে লজ্জাবতী বানরের উপর পিটাছড়ায় গবেষণা কার্যক্রম চলছে। তাদের উপযোগী বাস্তুসংস্থান তৈরির চেষ্টা চলছে। আমাদের ১৩ একরের বেশি সংরক্ষিত এলাকায় ৭ থেকে ৮টির মতো লজ্জাবতী বানরের দেখা পাই। আমরা দেখেছি তারা পোকার পাশাপাশি ৭–৮ প্রজাতির গাছের কষ খায়। এখন বনে সেরকম গাছ বেশি নেই। যেখানে বন ছিল সেখানে হয়তো বসতি হয়ে গেছে।
জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, পরিবেশ ও প্রকৃতি সুরক্ষায় প্রাকৃতিক বন সম্প্রসারণের পাশাপাশি বন্যপ্রানীর নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে। প্রাকৃতিক বন পরিবেশের মূল উপাদান। বন থাকলে বন্যপ্রাণী বাঁচবে। এই দুটি উপাদান সুরক্ষার করতে পারলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশীয় প্রজাতির চিরসবুজ বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে বন সৃজনের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছে বন বিভাগ। সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে দুর্লভ প্রজাতির লজ্জাবতী বানর, গন্ধগোকূল, পাহাড়ি ময়না, টিয়া, গুইসাপসহ বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে বনে অবমুক্ত করেছে বন বিভাগ। বন্যপ্রাণীর সুরক্ষায় বন বিভাগের তৎপরতার কথা জানান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা।
তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী বনের অংশ। বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার হচ্ছে এমন তথ্য আসলেই বন বিভাগ তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে আমরা দুর্লভ ও বিপন্ন প্রাণী উদ্ধার করে বনে অবমুক্ত করেছি। এখানে বন সুরক্ষায় চিরসবুজ বৃক্ষের সম্প্রসারণ বিভিন্ন অংশীজনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে মিশ্র প্রজাতির গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। বন ঠিকে থাকলে বন্যপ্রাণী সুরক্ষিত থাকবে। কেউ যাতে বন্যপ্রাণী শিকার না করে সেজন্য মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছি। এছাড়া বন্যপ্রাণী পাচার করলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।