বন্ধ না করে চিনিকলগুলোর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রয়োজন

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ৪ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

২০২০ সালের নভেম্বরে সরকার লোকসানের অজুহাতে সরকারি মালিকানাধীন ও পরিচালিত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টিতে (পাবনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, পঞ্চগড়, শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ) আখমাড়াই বন্ধ করে পার্শ্ববর্তী চিনিকলগুলোতে আখ মাড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও এর আগে লোকসানের জন্য ২টি সরকারি চিনিকল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হস্তান্তর করা হয়েছিলো। এরপর ২টি আখমাড়াই সিজন চলে গেছে। প্রথম সিজনে চিনি উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় কমেছে প্রায় ৪১% ও পরের বছরে কমেছে ৫০%। ঐদিকে আখ বিক্রির নিশ্চয়তা না পেয়ে কৃষকেরা আখ চাষ বাদ দিয়ে অন্য কৃষিপণ্য আবাদে চলে গেছে। অথচ একই সময়ে একই আবহাওয়ায় ভারতে চিনি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। তাহলে প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে সরকারি চিনি শিল্প সংকুচিত হচ্ছে কেন? তাহলে কি আমরা বলতে পারি দেশীয় চিনির (ব্রাউন সুগার) চাহিদা নেই? আসলে বিষয়টা তেমন নয়। দেশীয় চিনি পায় না বলেই মানুষ রিফাইন সুগার (অস্বাস্থ্যকর ঘনীভূত সাদা চিনি) কেনে। যদিও বাংলাদেশ কখনো চিনি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলো না। সবসময় চিনি আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হয়েছে। তবে দেশীয় চিনির চাহিদা সবসময়ই ছিলো, এখনো আছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন, এর মধ্যে ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল থেকে উৎপাদন হতো মাত্র ৮০ হাজার মেট্রিক টন। বাকী ১৭ লাখ ২০ হাজার মে. টনের চাহিদা মিটায় বেসরকারি উৎপাদনকারীরা। তারা র-সুগার আমদানি করে রিফাইনের মাধ্যমে বাজারজাত করে। তবে কেন সরকারি ছয়টি চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ? এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের মতামত হলো, সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ছয়টি কারখানায় আখ মাড়াই স্থগিত করা হয়েছে। এর শ্রমিকরা অন্য মিলে বদলী হবেন। আর এসব মিলে যেসব চাষী আখ সরবরাহ করতেন, তাদের আখ অন্য মিল নেবে। ওনাদের মতে চিনিকলে শুধু চিনি উৎপাদন করে টিকে থাকা যাবে না বরং প্রাসঙ্গিক আরও অনেক কিছু করতে হবে। অনেক মিলের যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে গেছে। এদের জীবনকাল শেষ হয়েছে ৩০ বছর আগে, তাই আধুনিকায়ন দরকার। সেটি করার জন্যই চিনিকলগুলোর আখ মাড়াই স্থগিত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আরো মনে করেন, বড় আকারের এসব চিনিকলে শুধুমাত্র চিনি উৎপাদনে সীমাবদ্ধ থাকাটাই একটা বড় সমস্যা। বাই প্রডাক্ট হিসেবে বায়ো ফার্টিলাইজার, স্পিরিট, ডিস্টিলারি, জীবাণু নাশক ও অ্যালকোহল উৎপাদন করতে হবে। তবেই চিনিকলগুলো লাভজনক হবে। সেজন্যই চিনিকলগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারা বলেন, বাংলাদেশে যে আখ উৎপন্ন হয়, তাতে চিনির পরিমাণ কম, আর সে কারণে উচ্চ ফলনশীল জাতের আখ চাষ করতে হবে, যাতে অল্প আখে বেশি চিনি পাওয়া যায়।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন চিনিকলগুলোর বর্তমান যে অবস্থা, তা বছরের পর বছর দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফসল। তারা বলেন, সরকার সবখাতকে প্রণোদনা দিলেও আখচাষীদের কখনো প্রণোদনা দেয়নি। সময়মত আখ কেনা, টাকা পরিশোধ করা, বীজের মান বাড়ানো, বীজ দেয়া ও আখ উৎপাদনে তদারক ও সমন্বয় না করলে আখের মান উন্নত করা যাবে না। পাশাপাশি জমির পরিমাণ ও মিলের সক্ষমতা কমেছে, যেগুলোতে কখনও দৃষ্টি দেয়া হয়নি। তারা আরো বলেন, চিনিকলগুলোতে নতুন বিনিয়োগ, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু এগুলো না করে মিলগুলোকে ক্রমশ ঋণগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে। ফলে বর্তমানে চিনিকলগুলোর পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
তবে আশার কথা হলো, কেরু এন্ড কোং গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৪০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। উপজাত হিসেবে যাতে শুধু মদ বিক্রি করেছে ৩৬৭ কোটি টাকার। যা আগের অর্থ বছরের থেকে ৩০% বেশি, এতে লাভ হবে ১০০ কোটি টাকার উপরে। তবে সুগার ইউনিটের লসকে সমন্বয় করলে নিট লাভ হবে ৬০-৭০ কোটি টাকা। কেরুর রয়েছে একটি ডিস্টিলারি সেকশন যেখানে মদ বা ফরেন লিকার উৎপাদিত হয়।
সারাদেশে কেরুর ১৩টি ওয়ার হাউজ, ৩টি সেলস সেন্টার রয়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে পাবনার রূপপুর, কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় ১টি করে বিক্রয় কেন্দ্র এবং রাজশাহী ও রামুতে একটি করে ওয়ার হাউজ নির্মাণ করা হবে। কেরু হুইস্কি, জিম, ব্রান্ডি, রাম, ভদকা, কুরাকার্ডা সহ ৯ টি ব্রান্ডের মদ উৎপাদন করে। যা ১৭৫, ৩৭৫ ও ৭৫০ এমএল বোতলে প্যাক করে বাজারজাত করা হয়। কেরু বছরে ২৬ লাখ লিটার দেশি স্পিড বা দেশি মদ ও ৮ লাখ লিটার জিনেচার স্পিড উৎপাদন করে। এছাড়াও ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সার, চিনি ও গুডের মত পণ্য তৈরি করে। লিকারের মধ্যে তৈরি করে কান্ট্রি স্পিরিট, রেক্টিফাইড স্পিরিট, জিনেচার স্পিরিট, এবসোলিউট এলকোহল। এদিকে কেরু গত ৫ বছরে চিনিতে লস দিয়েছে মোট ৩৩৬ কোটি। ১৯৩৮ সালে চুয়াডাংগা জেলার দামুরহুদা উপজেলার দর্শনায় ৩৫৭২ একর জমিতে কেরু এন্ড কোং প্রতিষ্ঠিত হয়। যার মধ্যে ২৪৫০ একর জমিতে কৃষকদের দিয়ে আখ চাষ করা হয়, যার পুরোটা কেরু এন্ড কোং কিনে নেয়। তবে কেরু বাইরের উৎপাদিত আখও কিনে। কেরু এন্ড কোং এর উৎপাদিত চিনি বাজারজাত করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন। কেরু এন্ড কোং চিনি উৎপাদনকারী হলেও মূলত চোলাই মদ উৎপাদনের জন্য এটি পরিচিত। আখ থেকে চিনি বের করার পর তিনটি উপজাত পাওয়া যায়। এগুলো হলো মোলাসিস বা চিটাগুড়, বেগাস বা ছোবড়া এবং প্রেসমার্ড বা গাধ। সেখান থেকে মোলাসেসকে বিশাল বিশাল ট্যাংকে ভরা হয়। তারপর দেওয়া হয় নির্দিষ্ট পরিমান ইস্ট। এতে মোলাসিস এলকোহল তৈরির উপযোগী হয়। ইস্ট মিশানোর পর মোলাসিসকে ৭২ ঘণ্টা পারমেন্টেশনের জন্য রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় এতে এলকোহল তৈরি হয়। তারপর একে তাপ দিয়ে ভেপর বা বাষ্প তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে ঐ উত্তপ্ত বাষ্পকে ঠাণ্ডা করে তরলে রূপ দেওয়া হয়। যা পরিশুদ্ধ বা পিউরিপাইরেড এলকোহল। পরে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এর থেকে রেকটিফাইড স্পিরিট, কান্ট্রি স্পিরিট, একস্ট্রা নিউট্রাল এলকোহল, ডিনেচার স্পিরিট ও এবসোলিউট এলকোহল তৈরি করা হয়। এরমধ্যে একস্ট্রা নিউট্রাল এলকোহল উচ্চমান সম্পন্ন, যা থেকে তৈরি হয় কেরুর ইউরো লেবেল মন্টেড হুইস্কি, গোল্ডেন রিবন জিন। রেকটিফাইড স্পিরিট থেকে তৈরি হয় ফাইন ব্রান্ডি, চেরী ব্রান্ডি,অরেঞ্জ ক্রেক আউট, ইমপেরিয়াল হুইস্কি, জরিনা ভদকা। কান্ট্রি স্পিরিট দিয়ে তৈরি হয় কেরুর রোজা রাম, ওল্ড রাম। এগুলো সব কেরুর ফরেন লিকার হিসাবে পরিচিত। ঢাকা চট্টগ্রাম দর্শনা থেকে লাইসেন্সে ধারীরা এগুলো কিনতে পারেন। বছরে ৩৯ লাখ ২০ হাজার বোতল ফরেন লিকার ও ২৬ লাখ লিটার বাংলা মদ উৎপাদন করে কেরু এন্ড কোং। শুধু যে কেরু এন্ড কোংতে বাই প্রোডাক্ট হিসাবে মোলাসিস উৎপন্ন হয় তা কিন্তু নয়। প্রতিটি চিনিকলেই মোলাসিস উৎপন্ন হয়। তাই সেই মোলাসিসকে কাজে লাগানোর জন্য প্রতিটি চিনিকলে আলাদা ডিস্টিলারি সেকশন স্থাপন করা দরকার। কারণ আমরা স্বীকার করি বা না করি, বর্তমানে দেশে প্রচুর পরিমাণে মদের চাহিদা রয়েছে ও তা প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। যার জন্য বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বৈধ বা অবৈধ পথে মদ আনা হয়। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে মদের বিশাল বাজার। এসব বাজারে বাংলাদেশের মদ রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়। তাই চিনিকলগুলোকে দ্রুত আধুনিকায়ন করে তাদের সক্ষমতা বাড়নো ও ডিস্টিলারি সেকশন স্থাপন করা দরকার। মনে রাখতে হবে, শুধু কেরু এন্ড কোং যদি এক বছরে ৬০-৭০ কোটি টাকা নীট লাভ করতে পারে, তাহলে ১৭টি মিলে প্রতিবছর নীট লাভ হবে প্রায় ১০০০ কোটি টাকার মত। এতে ২-৩ বছরে চিনিকলগুলোর তাদের পুঞ্জিভূত ঋণ শোধ করে লাভের ধারায় ফিরবে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের কন্যারা! সগৌরবে মহিমান্বিত হও
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল