সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার হোতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান ওরফে শাহিন মিয়ার নাম বলেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবির ভাষ্য, হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল। কলকাতায় সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের মাস খানেক আগেই ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরার বাসায় বসে খুনের ছক আঁটা হয় বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, সংসদ সদস্যকে হত্যার পর শরীরের বিভিন্ন অংশ টুকরো করে হলুদ লাগিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার কারণে লাশ উদ্ধার করা কঠিন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ। খবর বিডিনিউজের।
হারুন বলেন, ঘটনার মাস্টারমাইন্ড যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান ওরফে শাহীন। তার সঙ্গে ছিলেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ অনেকগুলো মামলা রয়েছে। এক মাস আগে থেকে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়। ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি বাসায় একাধিকবার বসে তারা এই হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু তারা কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চায়নি, ধরা পড়ার ভয়ে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ভারতে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা আবার চলে আসবে, সে মোতাবেক তারা কাজ করেছে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী আমানুল্লাহর প্রকৃত নাম শিমুল জানিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন বলেন, হত্যাকাণ্ডস্থলে ছিলেন আখতারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী শিলাস্তি রহমান। আমানউল্লাহ, শিলাস্তি ও ফয়সাল নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। এর বাইরেও এ ঘটনায় ভারতীয় কিছু লোকজন টাকার বিনিময়ে হত্যাকারীদের জন্য কাজ করেন।
হত্যা যেভাবে : সংসদ সদস্য আনারকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, পরিকল্পনা মোতাবেক তারা ২৫ এপ্রিল কলকাতার সেই বাসাটি ভাড়া করে। চুক্তি হয় তারা ৩০ এপ্রিল সেই বাসায় উঠবে। সেই মোতাবেক আখতারুজ্জামান শাহীন, আমানউল্লাহ ও শিলাস্তি ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে ফ্লাইটে কোলকাতা গিয়ে সেই বাসায় ওঠেন। তারা বোঝাতে চেয়েছিল যে এখানে পরিবার থাকবে। সেখানে গিয়ে তারা আরও দুজনকে হায়ার করে। এই বাসাতে আসা–যাওয়া করবে তারা। এর মধ্যে একজন জিহাদ অথবা জাহিদ, আরেকজন সিয়াম। আর মাস্টারমাইন্ড শাহীন কোন গাড়িটা– কোথায় ব্যবহার হবে, কাকে কতো টাকা দিতে হবে, কারা হত্যায় থাকবে– সবকিছু ঠিকঠাক করে ১০ মে বাংলাদেশে আসেন।
ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, দুই মাস ধরে তারা খেয়াল রাখছিল কোন সময় সংসদ সদস্য আনার কলকাতায় যাবেন, তিনি মাঝে মধ্যেই কলকাতা যান। গত ১২ মে কলকাতায় গিয়ে তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন এমপি আনার। তার আগে থেকেই শাহীনরা জানেন যে এমপি আনার ১২ তারিখ যাবেন। ১৩ মে এই চক্রটির ফয়সাল নামে এক ব্যক্তি একটি সাদা গাড়িতে এমপি আনারকে রিসিভ করে। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা আরেকটি গাড়িতে ওঠে। সেই গাড়িতে এমপি আনার ও ফয়সাল ছাড়াও আমানউল্লাহ ছিলেন।
রাজা নামের একজন গাড়িটি চালাচ্ছিলেন জানিয়ে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, ভারতীয় নাগরিক রাজা এসব কিছু জানে না, সে জাস্ট ক্যারিয়ার। ওই বাসার যাওয়ার পর আরেক ব্যক্তি মুস্তাফিজও সেই বাসায় ঢোকেন। ১৩ মে ২টা ৫১ মিনিটে তারা সবাই ঢুকেছে। আগে থেকেই ভেতরে ছিল জিহাদ ও সিয়াম। আধা ঘণ্টার মধ্যেই কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে। এবং তারা হত্যার এক ঘণ্টা পরে একজন– এমপি আনারের মোবাইলটা নিয়ে বের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় কল করেন; মানে বিভ্রান্ত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে।
লাশ সরানো হয় যেভাবে : অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন বলেন, তাদের পরিকল্পনা ছিল বিদেশের মাটিতে তারা হত্যা করবে এবং লাশটাকে এমনভাবে গুমকরবে যাতে কেউ কোনোদিন না পায়। এরপর তারা লাশটাকে ছোট ছোট টুকরো করে ফেলেছে। হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলেছে। তারা ওই হাড়–মাংসগুলোর সঙ্গে হলুদ ও মসলা মিশিয়ে দিয়েছিল; যাতে পথে কেউ ধরলে– তারা বলতে পারে যে, এটা বাজার থেকে কেনা মাংস। উদ্দেশ্য ছিল এমনভাবেই গুম করা হবে যাতে কেউ কোনোদিন তার কোনো অস্তিত্ব না পায়।
ঘটনার বীভৎসতার বর্ণনা দিয়ে হারুন বলেন, ১৩ মে আমানউল্লাহ, জিহাদ ও সিয়াম দুটো স্যুটকেসে করে সেই দেহের টুকরোগুলো ভরে পাবলিক টয়লেটের সামনে দাঁড়ানো একটি গাড়িতে ওঠে। সেই গাড়ির ড্রাইভারও তেমন কিছু জানতো না। এরপর সিয়াম ও জিহাদকে স্যুটকেসসহ বিদায় করে আমানউল্লাহ আবার বাসায় চলে আসে। পরের দিন আমান উল্লাহসহ পরের দুইজন বাকি মাংসগুলোকে পলিথিনে পেঁচিয়ে ব্যাগে ভরে তারাও বের হয়ে যায়।
ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, ১৫ মে আমানউল্লাহ ও শিলাস্তি রহমান বাংলাদেশে আসেন। ১৬ মে মুস্তাফিজ চলে আসে। ওরা সবাই যখন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে, তারপরে আখতারুজ্জামান শাহীন ভিসতারা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে দিল্লি যান। সেখানে দুই ঘণ্টার বিরতি শেষে তিনি কাঠমাণ্ডুর ফ্লাইটে চাপেন। সেখান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে পারেন। যে সকল আসামি আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছে আমরা সব জেনেছি। তারা আমাদের কাছে সব স্বীকার করেছে। সেই বিষয়গুলো আমরা ভারতের তদন্ত সংস্থা ও পুলিশকে জানিয়েছি। তারাও কিছু কিছু উদ্ধার করেছে।
হত্যার কারণ কী : কী কারণে সংসদ সদস্য আনার খুন হয়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন বলেন, এটা যে কারণেই হোক, আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে সব বলতে পারব। এখন আমাদের কাজ আসামিদের গ্রেপ্তার করা।
ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, মাস্টারমাইন্ডের ডাক নাম শাহীন, আসল নাম আখতারুজ্জামান। তার গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি। আর যে মূল কাজটা করেছে তার নাম আমানউল্লাহ (পাসপোর্ট অনুযায়ী)। কিন্তু তার আসল নাম আরেকটা, সে নতুন পাসপোর্ট নিয়ে আমনউল্লাহ সেজেছে। সে গলাকাটা পার্টি, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। তার বিরুদ্ধে খুলনা, যশোর ওই এলাকাগুলোতে হত্যাসহ অনেকগুলো মামলা রয়েছে। এই আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল হত্যাকাণ্ডের মূল সংগঠক হিসেবে কাজ করেছে।
দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, তারা ভিকটিমের মোবাইল থেকে বিভিন্ন সময় মেসেজ দিছে। কোনো সময় গোপাল বিশ্বাসের ফোনে রিং দিয়েছে, একটা মেসেজও পাঠিয়েছে যে, আমি দিল্লি যাচ্ছি। সেখানে তিনি অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করবেন। তারা পুরো বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে নিতে এই কাজ করেছে। কোনো সময় তারা মোবাইল নিয়ে গেছে বেনাপোল, কোনো সময় মোজাফফরাবাদ। তার এপিএসসহ আরও অনেকের কাছে মেসেজ দেয়। ঘটনাটি হানি ট্র্যাপ ছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন বলেন, হানি ট্র্যাপ ছিল কি না, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে ঘটনাটি কি না কিংবা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এখানে আছে কি না; সবকিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঢাকায় ভারতীয় গোয়েন্দা দল : আনার খুনের ঘটনায় ডিবি হেফাজতে থাকা তিনজন হলেন– আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমান ও ফয়সাল আলী ওরফে সাজি। ভারতীয় পুলিশের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে তাদের আটক করে বাংলাদেশের পুলিশ। এই তিন সন্দেহভাজনের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারত থেকে আসা চার তদন্তকারী। বৃহস্পতিবার রাতে তারা বেইলি রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ের ওয়ারী বিভাগের কক্ষে সন্দেহভাজন এবং ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে কথা বলেন। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ভারতীয় কর্মকর্তারা ডিবি কার্যালয়ে আসেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তারা ওয়ারী বিভাগের কক্ষ থেকে বেরিয়ে ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের দপ্তরে যান।
পরে অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, ডিবি হেফাজতে থাকা সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা ডিবির কাছে ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছিল, সেই একই বর্ণনা ভারতের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছেও দিয়েছে। আর ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিয়ে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের লাশ বা দেহের অংশ উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে দেশের পুলিশ। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা ঢাকার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। বৃহস্পতিবারই তারা বাংলাদেশে আসেন।