“বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।” (বন্দী শিবির থেকে, শামসুর রাহমান)
বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান। তাঁর কবিতা দেশপ্রেম ও সামাজিক সচেতনতায় ভরপুর। নাগরিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণ–আন্দোলন তাঁর কবিতায় রূপায়িত হয়েছে গভীর সংবেদনশীলতায়। শামসুর রাহমানের খ্যাতি ও পরিচিতি এর আগে থেকে কিছুটা থাকলেও প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে তাঁর বন্দী শিবির কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় চৈতন্য আর শিল্পের অনন্য সংযোগ ঘটেছে। পূর্ব বাংলার মানুষ আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শামসুর রাহমানের কবিতা লক্ষ করলে দেখব, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসামপ্রদায়িক চেতনাই সেদিন ক্রিয়াশীল ছিল। হিন্দু মুসলিম সকলে মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছিল । এ গ্রন্থের মূল বিষয় স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন আবেগ ও প্রত্যাশা। এর অধিকাংশ কবিতা মুক্তিযুদ্ধকালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের এপ্রিল–ডিসেম্বর সময়ে রচিত। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটির শুরুতে ‘পূর্বলেখ’ শিরোনামে একটি ভূমিকা সংযোজন করে কবি তাঁর কাব্যরচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। ৩৮টি কবিতা এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত।
এ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন আবেগ ও প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের শহিদদের উদ্দেশে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর, ভয়াবহ বন্দীদশা তথা মুক্তিযুদ্ধের একাত্মতা সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে শামসুর রাহমানের এই বইয়ের কবিতায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত বন্দী শিবির থেকে কাব্যের কবিতায় অবরুদ্ধ ঢাকার চিত্রকল্প চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে–
“এ বন্দী শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।”
শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতায় শিল্পী সত্তার বিষয়টি সহজেই চোখে ধরা পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য অসম্ভব আবেগের ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সাহিত্যিক যেখানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন শামসুর রাহমান সেখানে সফল হয়েছেন। হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যে যা দেখেছেন লিখে ফেলেছেন, লক্ষ লক্ষ বুলেট নিক্ষেপ করেছেন কাগজে, ক্রাইম স্টোরি লেখার মতো করে…।’ কিন্তু শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ এই অভিযোগের খড়্গ থেকে মুক্ত বলেই মনে হয়। এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি কবিতাই আশ্চর্য শৈল্পিক সংযমে অসংযমকে ধারণ করেছে। কবি ঢাকা শহরে পাকিস্তানি তাণ্ডবের বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে, ‘আমার চাদ্দিকে দালান কেবলি যাচ্ছে ধসে,/ আমার সম্মুখে/ এবং পেছনে/ দেয়াল পড়ছে ভেঙে এক এক, যেন/ মাতাল জুয়াড়ী কেউ নিপুণ হেলায়/ হাতের প্রতিটি তাশ দিচ্ছে ছুড়ে। আমি/ কত ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে হাঁটি/ করাল বেলায়। জনসাধারণ ছিন্ন/ মালার মুক্তোর মতো বিক্ষিপ্ত চৌদিকে।’
কবি যখন বলেন, ‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল অসামপ্রদায়িক চেতনা। তাইতো কবি ‘সকিনা বিবি’ আর ‘হরিদাসীর’ আত্মত্যাগকে পাশাপাশি রেখেছেন, সমান মর্যাদা দিয়েছেন। কবির ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় নজরুল আর রবীন্দ্রনাথকে সমানভাবে তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্নে একাকার করে দিয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘অজর কবিতা’কে স্বাধীনতার সমার্থক মনে করেছেন এবং নজরুলের ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’কেও স্বাধীনতা হিসেবে অনুভব করেছেন। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার কবিতা ও সংস্কৃতি থেকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তার বিপরীতে শামসুর রাহমানের কবিতায় এসব মিথের ব্যবহার জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকাশ করেছেন । ১৯৭১–এ দ্বিধাহীন চিত্তে প্রায় অস্ত্র ছাড়াই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ঘর ছেড়েছে পূর্ব বাংলার মানুষ। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সর্বস্তরের মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিল সেদিন। সকলকে এক কাতারে দাঁড় করানোর এই কাজটি করেছিল জাতীয়তাবাদী চেতনা। অর্থনৈতিক সাম্যের যে ধারণা জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে ছিল, তা–ই সাত কোটি মানুষকে এক পতাকার তলে দাঁড় করেছিল।
কবির ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’ ‘খাণ্ডবদাহন’–কবিতার চরণে হিন্দু মিথের ব্যবহার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ মূর্ত হয়ে উঠেছে কবির কলমে। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাজারো ঘটনা ঘটেছে। হাজারো মানুষের মধ্যে এই যুদ্ধ হাজারো মাত্রায়, হাজারো স্বপ্ন দেখিয়েছে । জনগোষ্ঠীর কবি হিসেবে এগুলোর অনুবাদ হাজির করেন বড় কবিরা। কবি তো আকাশ থেকে ভাষা পান না। ভাষা পান তাঁর চারপাশ থেকে। কবি শামসুর রাহমান তাঁর চারপাশ থেকে পাওয়া ভাষাই ব্যবহার করেছেন নিপুণভাবে। মুক্তিযুদ্ধ যে একটা জনযুদ্ধ ছিল, এখানে যে সবাই ২৪ বছরের শোষণ–বঞ্চনার হিসাব নিতে মিলিত হয়েছিল, এটা যে গরিব মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত ছিল, ‘বন্দী শিবির থেকে’ সেটি কবি বলে ফেলেছেন এক নিশ্বাসে আপন বিশ্বাসে জাতীয়তাবাদী চেতনা সব সময় আপন জাতির আত্মত্যাগকে গৌরবান্বিত করতে চায়। এই প্রবণতা প্রকাশ করেছে ‘মধুস্মৃতি’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তরে’ আর ‘তার উক্তি’ কবিতায়। একই সঙ্গে ‘শহীদ মিনার’–এর সূত্র ধরে বায়ান্নর স্মৃতিকে স্মরণ করতেও ভুল করেননি কবি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন–সংগ্রামের চরম মুহূর্তে বড় কবির সাহিত্য জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার যে দায়িত্ব নেয়।
শামসুর রাহমানের বন্দী শিবির থেকে বায়ান্নর স্মৃতি স্মরণ করেছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে । যেমন-‘অথচ জানে না ওরা কেউ/ গাছের পাতায়, ফুটপাতে/ পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে/ পথের ধুলায়/ বস্তির দুরন্ত ছেলেটার/ হাতের মুঠোয়/ সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি’ (‘বন্দী শিবির থেকে’)। ‘গেরিলা’ কবিতার চরণসমূহ তাইতো এরকম-‘তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর/ সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ–তাড়ানিয়া’ অথবা ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি–প্রতিধ্বনি তুলে,/ নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি্বদিক/ এই বাংলায়/ তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা’ শামসুর রাহমানের ‘গ্রামীণ’ কবিতায় দেখিয়েছেন একাত্তরে মানুষ কীভাবে বদলে যাচ্ছিল। একাত্তর তো বদলে দিয়েছিল লাখো বাঙালিকে।
ত্রিশ লাখ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার হয়েছিল। কিন্তু বাকিরাও কি মর্মে–হত্যার শিকার হয়নি? এই মর্মে–হত্যাও তো গণহত্যার আওতাভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের কাব্য–কবিতা সাধারণত এই হত্যা সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকে। বন্দী শিবির থেকে অকথিত, অনুল্লেখিত এসব হত্যার দলিল হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি কবিতার পরতে–পরতে আছে এসব হত্যার নির্মম বর্ণনা। উল্লেখ করা যেতে পারে পারে কয়েকটি লাইন, ‘আমিও নিজেকে ভালোবাসি/ আর দশজনের মতন। ঘাতকের/ অস্ত্রের আঘাত/ এড়িয়ে থাকতে চাই আমিও সর্বদা।/ অথচ এখানে রাস্তাঘাটে/ সবাইকে মনে হয় প্রচ্ছন্ন ঘাতক।/ মনে হয়, যে কোনো নিশ্চুপ পথচারী/ জামার তলায়/ লুকিয়ে রেখেছে ছোরা, অথবা রিভলবার, যেন/ চোরাগোপ্তা খুনে/ পাকিয়েছে হাত সকলেই।’ (‘না, আমি যাবো না’)। সশামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যটি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিচিত্র প্রবণতাকে ধারণ করে চব্বিশ বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিকল্প হয়ে উঠেছে সফলভাবেই । যা হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও অসামন্য দলিল। এ কারণেই শামসুর রাহমান বাঙালির বড় কবি, স্বাধীনতার কবি।












