বেসরকারি কন্টেনার ডিপোগুলোর গড়ে ৫০ শতাংশ চার্জ বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকট নিরসনে বন্দর কর্তৃপক্ষের নেয়া উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। বেসরকারি ডিপোগুলোতে কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধির কারণে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর ব্যবহারকারী ও বিকডাকে এক টেবিলে বসায়। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়েছে। গতকাল সকালে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেও উভয় পক্ষকে এক কাতারে আনতে না পেরে হতাশা ব্যক্ত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ এক লাফে এত বাড়ানোর ফলে ব্যবসা–বাণিজ্যে ধস নামবে। বিকডা বলেছে, চার্জ বাড়ালেও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে খরচ তেমন বাড়ছে না। তাছাড়া বিকডার যাবতীয় চার্জ পরিশোধ করে বিদেশি বায়ার। এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ অহেতুক বিষয়টিকে ঘোলা করছে। বিকডা বর্ধিত চার্জ আদায় করবে বলে জানিয়েছে। এদিকে এক মাসের মধ্যে বিষয়টির সুরাহা না হলে বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানাবে বলে বৈঠকে জানিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসরকারি উদ্যোগে ১৯টি বেসরকারি আইসিডি গড়ে তোলা হয়। এসব আইসিডিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনার হ্যান্ডলিং কিংবা গতিশীলতা এসব আইসিডির কার্যক্রমের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। বেসরকারি আইসিডিগুলোতে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় দ্বিগুণ কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেনার ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার টিইইউএসের কাছাকাছি। বেসরকারি আইসিডিগুলোর ধারণক্ষমতা এক লাখ ছয় হাজার টিইইউএস। বেসরকারি আইসিডিগুলোতে বছরে প্রায় ২২ লাখ কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়। এসব আইসিডিতে রপ্তানির সব পণ্যই কন্টেনারজাত করে জাহাজিকরণের জন্য বন্দরে পাঠানো হয়। অপরদিকে বন্দরের ইয়ার্ডে নামা ৬৫ ধরনের আমদানি পণ্য চলে যায় এসব আইসিডিতে, যেখান থেকে খালাস করা হয়। ফলে এ খাতের ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে পড়বে।
বিকডা ১৯টি বেসরকারি কন্টেনার ডিপো বিভিন্ন সেবার চার্জ গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে বৃদ্ধি করেছে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, এক লাফে গড়ে ৫০ শতাংশ চার্জ বৃদ্ধির কারণে বিদেশি বায়াররা বাংলাদেশ বিমুখ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ট্যারিফ কমিটির মতামত বা কোনো তোয়াক্কা না করে বিকডা একতরফা কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ গড়ে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে সংকট তৈরি করেছে।
বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, ট্যারিফ কমিটির কোনো বৈধতা নেই। আমাদের থেকে একজন, সরকারিভাবে তিনজন এবং সেবা গ্রহীতাদের নয়জন নিয়ে গঠিত ওই কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আমরা ২০১৯ সালে হাই কোর্টে রিট করি। আদালত থেকে ওই রিটের কোনো রায় দেয়া হয়নি। বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে। ট্যারিফ কমিটিতে সেবা গ্রহীতারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় ওখান থেকে আমাদের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত আসবে বলে আমরা মনে করি না। তাই বৈধতা নিয়ে চ্যালেঞ্জে থাকা ওই কমিটির সাথে আলোচনা করে ট্যারিফ বাড়ানোর সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, যৌক্তিক কারণেই ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এর বিকল্প ছিল না। তাছাড়া ট্যারিফ বৃদ্ধিতে দেশের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের কোনো ক্ষতি হবে না। বিদেশের আমদানিকারকই ট্যারিফ পরিশোধ করবেন। ডলারের দামের সাথে সমন্বয় করায় এই চার্জ কোনো প্রভাব ফেলবে না। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ব্যাপারটি হিসাব করলে কোনো কোনো সেবা খাতে ৮ শতাংশ, কোনো কোনো সেবা খাতে এক শতাংশও ট্যারিফ বাড়ছে না। বরং কমেছে। আমাদেরকে যারা পেমেন্ট করে তারা বিদেশি বায়ারের কাছ থেকে ডলারে পেমেন্ট নেয়। আমাদেরকে দেশীয় মুদ্রায় দেয়।
সূত্র জানিয়েছে, ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া নতুন ট্যারিফ অনুযায়ী ২০ ফুটি একটি কন্টেনারের প্যাকেজ চার্জ ৬ হাজার ১২৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ৯০০ টাকা করা হয়েছে, যা প্রায় ৬২ শতাংশ বেশি। ৪০ ফুটি কন্টেনারের চার্জ ৮ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩ হাজার ২০০ টাকা, ৪০ ফুটি হাইকিউব কন্টেনারের চার্জ ৮ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার ৯০০ টাকা করা হয়েছে। পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জিওএইচ কার্গোর চার্জও বাড়ানো হয়েছে, যেখানে ২০ ফুটি কন্টেনারের জন্য ১১ হাজার ৯০০ টাকা, ৪০ ফুটি কন্টেনারের জন্য ১৫ হাজার ২০০ টাকা এবং হাইকিউব কন্টেনারের জন্য ১৬ হাজার ৯০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। রেফার কন্টেনারের প্লাগইন চার্জ ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। ডকুমেন্টশন চার্জ ২৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫০ টাকা, ২০ ফুটি খালি কন্টেনার পরিবহন ১৭০৫ থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা, সিএফএস স্টোরেজ প্রতিদিন ২৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে। ভিজিএম চার্জ আগে ছিল না, নতুন ট্যারিফে ১৭২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অবশ্য রপ্তানিকারকরা বলেছেন, চার্জ বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অস্বাভাবিক হারে ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে বিদেশি বায়াররা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশের রপ্তানি খাত সংকটে পড়বে। আমরা ওই সংকটের মুখে পড়ে গেছি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, চার্জ বাড়ানোর নিয়ম কানুন আছে। আইসিডিগুলোতে কীভাবে চার্জ বাড়ানো হবে তার জন্য একটি কমিটি আছে। আমাদের সাথে আলোচনা করার সুযোগ ছিল। কিন্তু কোনো কিছু না করে একতরফাভাবে চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সাথেও বিকডা কোনো আলোচনা করেনি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান বিষয়টি নিয়ে আগেও একবার আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেটি হয়নি। তিনি গতকাল নতুন করে বৈঠকের আয়োজন করেন। উভয় পক্ষকে এক টেবিলে বসিয়ে বিষয়টি সুরাহা করার উদ্যোগ নেন। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর প্রায় ১টা পর্যন্ত বৈঠক চলে। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উভয় পক্ষ স্ব স্ব অবস্থানে অনঢ় থাকে। বিকডা বাড়তি চার্জই আদায় করবে বলে জানিয়ে দেয়।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এস এম মনিরুজ্জামান উভয় পক্ষকে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে ট্যারিফ নির্ধারণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এক মাসের মধ্যে আপনারা সেটা করতে না পারলে আমরা সবকিছু জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেব। ওখান থেকে ট্যারিফের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে।
ফলে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয় জানিয়ে বন্দরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা হতাশা ব্যক্ত করেন। বৈঠকে বিকডা ছাড়াও বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশন, ফ্রেইট ফরোওয়াডার্সসহ বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।