চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট ডিসি পার্ক এলাকায় সংঘটিত ঘটনার জের ধরে গতকাল নগরী জুড়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। প্রাইম মুভার চালক ও সহকারীদের কর্মবিরতি এবং অবরোধের মুখে বন্দর, পোর্ট কানেক্টিং রোড, সল্টগোলা ক্রসিংসহ সন্নিহিত পুরো এলাকা স্থবির হয়ে পড়ে। বন্দর থেকে পণ্য আনা নেয়া বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য জাহাজীকরণেও দেখা দেয় স্থবিরতা। প্রাইম মুভার চালক এবং সহকারীদের মারধরের অভিযোগে চার দফা দাবিতে মঙ্গলবার রাত ৯ টা থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন অবশেষে গতরাতে গিয়ে সুরাহা হয়েছে। গত রাত ৮টা নাগাদ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার শ্রমিক নেতাদের সাথে জেলা প্রশাসনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক উপস্থিত ছিলেন।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার শ্রমিক নেতাদের সাথে বৈঠক হয়েছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, অবিলম্বে তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন। যে ৪ দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে গিয়েছিল প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার শ্রমিকরা সেগুলো হলো– শ্রমিকদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা, আহতদের চিকিৎসা ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, ডিসি পার্কে প্রবেশের বিকল্প পথ ব্যবস্থা করা এবং সড়কে শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদান। এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ মাহবুবুল হক বলেন, এসব বিষয়ে একটা সমঝোতা হয়েছে। এরপরই শ্রমিক নেতারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন, এমনটা আশ্বস্ত করেছেন।
সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট ডিসি পার্ক এলাকায় গত মঙ্গলবার সাড়ে ৮ টার দিকে প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার শ্রমিকদের সাথে ডিসি পার্কের পাকিংয়ের দায়িত্বে থাকা লোকজনের হাতাহাতি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে জানিয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক বলেন, দ্রুত গতির একটি লরি (প্রাইম মুভার)একটি কারের উপর উঠে পড়ছিল। ডিসি পার্কের পার্কিংয়ের দায়িত্বে থাকা লোকজন লরির চালককে এর কারণ কী এবং তার লাইসেন্স আছে কী না, সেসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি একগুয়েমি দেখায়। একপর্যায়ে চালকটিকে ধাক্কা দেই পার্কিয়ের দায়িত্বে থাকা লোকজন। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। যা মারামারিতে রুপ নিয়েছিল। সেখানে আরো চালক ও তাদের লেবাররা চলে আসে। পরে ডিসি পার্কে পাথর নিক্ষেপ ও ভাঙচুর করা হয়।
জানা গেছে, এ ঘটনার জেরে মঙ্গলবার রাত ৯ টা থেকে সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করে এবং সড়ক অবরোধ করেন। হামলার ঘটনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা সড়ক ছাড়বেন না বলেও জানিয়েছিলেন। নগরীর কাস্টমস এলাকায় ট্রাক, প্রাইম মুভার ও লরি চালকরা সড়কে মিছিল করেন এবং রাত ৯টার দিকে সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় রাস্তার উভয় পাশের গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেন। পরে গতকাল ভোর থেকে কিছুক্ষণ গাড়ি চলাচল করলেও এক পর্যায়ে শ্রমিকেরা আবারো সড়ক অবরোধ করে। তারা রাস্তার উপর এলোপাতাড়ি করে বড় বড় কন্টেনার মুভার রেখে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। শ্রমিকদের দাবি, মঙ্গলবার রাতে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটের ডিসি পার্কে বিএম ডিপোর এক প্রাইমুভার চালক ও সহকারীদের মারধর করে পার্কের দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি গার্ডরা। পরে শ্রমিকরা এর প্রতিবাদ করলে তাদের কয়েকজন শ্রমিককে আটকে রাখা হয়। গতকাল দুপুরে সরেজমিনে সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় দেখা যায়, প্রাইম মুভার শ্রমিকরা রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে একটি দুটি গাড়ি ছাড়া হলেও যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল। বন্দর থেকে কোন গাড়ি তারা বেরুতে কিংবা প্রবেশ করতে দেয়নি বলেও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রগুলো জানায়। রাস্তা বন্ধ করে রাখার ফলে বন্দর–পতেঙ্গা, অলংকার ও জিইসিগামী যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি রপ্তানি পণ্যবাহী কোন গাড়িই তারা বন্দরে ঢুকতে কিংবা বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে বের হতে দেয়নি। প্রাইম মুভার গাড়ি দেখলেই তারা আটকে রাখছেন। ফলে প্রাইম মুভার ও বন্দরে কোনো গাড়ি ঢুকতে না পারায় সেগুলো রাস্তার ওপর অলস দাঁড়িয়ে আছে, যার কারণে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজট। বাসে থাকা অনেক যাত্রীদের পায়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হতেও দেখা গেছে। কিছু বিক্ষোভকারী চালকদের কাছ থেকে গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেয়, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
এদিকে বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের অবরোধের মুখে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনা নেয়ার কার্যক্রম মূলতঃ মুখ থুবড়ে পড়ে। আইসিডিগুলো থেকেও বন্দরে কোন পণ্য প্রবেশ করতে পারেনি। এতে করে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চললেও আইসিডি থেকে সরাসরি হুক পয়েন্টে যাওয়া পণ্য বন্দরে না পৌঁছায় জাহাজীকরণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। শ্রমিকদের অবরোধের মুখে বন্দরের সবগুলো প্রবেশমুখই মূলতঃ বন্ধ হয়ে পড়ে। রাস্তায় শত শত কন্টেনার মুভার এলোমেলো করে রাখার ফলে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) বন্দর এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে বিকেলের দিকে বিমানবন্দর সড়কে কোনরকমে যান চলাচল শুরু করতে পারলেও বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারী এবং বন্দরে কন্টেনার প্রবেশের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ থাকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি এবং আইসিডি থেকে কন্টেনার বোঝাই পণ্য আসা বন্ধ ছিল। শ্রমিকদের অবরোধের কারণে আইসিডিগুলো থেকে কোন রপ্তানি পণ্যই জাহাজীকরণের জন্য প্রেরণ করা সম্ভব হয়নি। রাতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দাবি দাওয়ার ব্যাপারে সুরাহা হলে শ্রমিকেরা গাড়ি চলাচল শুরু করার ঘোষণা দেন। তবে রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বন্দরে পণ্য আনা নেয়া পুরোপুরি স্বভাবিক হয়নি। তবে রাতের মধ্যে পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।