বন্দরে চাঁদাবাজি নিয়ে শ্রম উপদেষ্টার বিস্ফোরক মন্তব্য

| শুক্রবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৮:৫৬ পূর্বাহ্ণ

শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বেশ সাহসিকতার সঙ্গে বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতিটি জায়গায় চাঁদাবাজি হয় এবং সেখানে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা অবৈধভাবে ওঠে। গত সোমবার সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক বছরের অর্জন ও সাফল্য নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পর্কিত প্রক্রিয়া নিয়ে করা রিট আবেদনের রায় বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমার মনে হয় যারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন তারা নতুন বেঞ্চে যাবেন অথবা প্রধান বিচারপতির শরণাপন্ন হবেন। তিনি বলেন, আমি রায়ের বিরুদ্ধে যাচ্ছি না, রায়ের কিছু বলছিও না। দুনিয়ার যেসব বন্দরে ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে এখানেই। পায়রা বন্দরে সরকার প্রতি বছর ২২ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন সেখান থেকে লাভ পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, আমি আশ্চর্য হই যখন আপনারা এসব পত্রিকায় দেন, কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করেন না চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন কত অবৈধ টাকা ওঠে। আমি একটি আনুমানিক হিসাব দিতে পারি, কিন্তু দিলে হয়তো তা নিয়ে বিতর্ক হবে। ন্যূনতম কত টাকা ওঠে? বন্দরের প্রত্যেকটি জায়গায় চাঁদাবাজি চলছে। ভেতরে ট্রাক দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকে, যা জায়গা হওয়ার কথা নয়। কেউ না কেউ চাঁদা নিচ্ছে। ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হলে বাইরে গিয়েও চাঁদা নেওয়া হয়। অতীতে চট্টগ্রামের যিনি মেয়র ছিলেন তিনি ‘মেয়র কম, বন্দর রক্ষক বেশি’ এমন মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরটা সোনার ডিম পাড়া মুরগির মতো। তাড়াতাড়ি জবাই করে সব ডিম বের করে ফেলো! প্রথমে বলা হয়েছিল, অমুককে সরালে বন্দর ডাউন হয়ে যাবে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আলোচনা করে ৫ শতাংশ কমাতে হলেও রাজি হয়েছিলাম। এখন দেখুন, আগে যেখানে দিনের পর দিন লাগত, সেখানে এখন একদিন, দেড় দিনের মধ্যেই কাজ শেষ হচ্ছে। তিনি বলেন, আপনারা ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞেস করেন না কেন? আমার সঙ্গে দেখা হওয়া শতভাগ ব্যবসায়ী বলেছেন, স্যার, ভালো কাজ করেছেন। এটা তো আগের পরিকল্পনা, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নয়। অনেক কাজ হয়েছে, তবে হয়নি কেন তা আপনারাই ভালো জানেন। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন আনুমানিক কত টাকা অবৈধভাবে ওঠে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আনুমানিক দুই থেকে আড়াই কোটি টাকাপ্রতিদিন। বন্দরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা আরও বেশি বলবে। দুইআড়াই কোটি টাকা বন্ধ করতে পেরেছেন কিনাএ প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, অনেক কমেছে। পুরোটা বন্ধ করতে পেরেছেন কিনা জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পুরোটা কমানো কি সম্ভব?

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর আমাদের প্রধান বন্দর। বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত, যা দেশের সিংহভাগ বাণিজ্য পরিচালনা করে। আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করতে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর রিজিওনাল ইকনোমিক হাব হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত, নেপাল এবং ভুটানের জন্য ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করে। এই গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালটি বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে সমপ্রতি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়েছিল।এই রিটের বিষয়ে হাইকোর্ট একটি বিভক্ত রায় দিয়েছে, যেখানে একজন বিচারপতি চুক্তি প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলেছেন এবং অন্যজন দ্বিমত পোষণ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন নেই; বরং প্রয়োজন আলোচনাকে বাস্তব সমাধানের দিকে নেওয়া। আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশ যদি ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে যেতে চায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ ও চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়নের বিলম্ব করার সুযোগ নেই; যদিও কিছু ব্যাপারে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে।এখন এ কথা শুনতে যতটা সহজ, বাস্তবে ততটা নয়। কারণ, বন্দর শুধু একটা অবকাঠামো নয়, বরং এটা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, লজিস্টিকস, মুদ্রানীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও প্রশাসনিক সংস্কারের কেন্দ্রবিন্দু। চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের অর্থনীতির প্রধান প্রবেশদ্বার। দেশের ৯২ শতাংশ সমুদ্রবাণিজ্য ও ৯৮ শতাংশ কনটেইনার কার্গো এখান দিয়ে ওঠানো নামানো হয়।

কিন্তু সেই বন্দরে যদি এতোটা অনিয়ম হয়, এতোটা চাঁদাবাজি হয়, তাহলে দেশের সমৃদ্ধি কীভাবে সম্ভব হবে। বছরের পর বছর ধরে যদি বন্দরকে দুর্নীতির অভয়ারণ্য বানিয়ে রাখা হয়, তাহলে তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কীভাবে নেওয়া যাবে। এখন কমিশন, ঘুষ, চাঁদাবাজি ও সুবিধার চিত্র ফুটে উঠেছে সবার পর্যবেক্ষণে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও দুর্নীতির বিস্তার কমেনি। শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টার বিস্ফোরক মন্তব্যে নড়ে চড়ে ওঠার কথা বন্দর সংশ্লিষ্টদের। তবে শুধু মন্তব্য করলেই হবে না। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে