ভয়াবহ রকমের কন্টেনার জটের কবলে চট্টগ্রাম বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে পড়া কন্টেনারের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বন্দর কর্তৃৃপক্ষ রাতে দিনে কাজ করে জট সামলানোর চেষ্টা করলেও পরিস্থিতির হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে। বন্দরের ইয়ার্ডে সৃষ্টি হওয়া কন্টেনারের পাহাড় সরাতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে সামনের দিনগুলোতে বেশ বেগ পেতে হবে বলেও সূত্র জানিয়েছে। গতকাল বন্দরের ইয়ার্ডে আটকে পড়া কন্টেনারের সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ১১৭ টিইইউএস। যা স্বাভাবিক সময়ে স্মরণকালের সর্বোচ্চ বলেও বন্দর সূত্র জানিয়েছে। শুধুমাত্র করোনাকালে রাস্তাঘাট সব বন্ধ থাকার সময় বন্দর ইয়ার্ডে কন্টেনারের এমন পাহাড় তৈরি হয়েছিল।
বন্দর সূত্র জানিয়েছে, কোটা আন্দোলন ইস্যুতে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জুলাই মাসের শেষদিকে দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ, সাধারণ ছুটিতে ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কারফিউতে পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে থাকায় দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য বড় ধরণের ধাক্কা খায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে ছিল। কারখানা থেকে আইসিডি কিংবা আইসিডি থেকে বন্দরে পণ্য পরিবহনও নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। ওই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে নামানো কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠে। যা আইসিডি, কারখানা কিংবা আমদানিকারকদের নিকট সরবরাহ দেয়া সম্ভব হয়নি। ওই সময় টানা পাঁচদিন বন্ধ থাকায় বন্দরে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বহু বেশি কন্টেনার আটকা পড়ে। রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বন্দরে ঢাকা আইসিডিমুখি কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠে। পাঁচদিন পর সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু এবং গত কয়েকদিন পুরোদমে কাজ করেও আগেকার সেই ধাক্কার ধকল সামলানো সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে সাত দিনের স্টোর রেন্ট মওকুফ করেছে সরকার। কন্টেনার খালাসকে উৎসাহিত করতে ব্যবসায়ীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নেয়ারও আহ্বান জানানো হয়েছিল। দেশে সীমিত পরিসরে কারফিউ বহাল থাকলেও বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন কার্যক্রম পুরোদমে গতি সঞ্চার করে।
আমদানি রপ্তানি কার্যক্রমও গতিশীল হয়। বিদেশ থেকে পণ্য বোঝাই প্রচুর কন্টেনার আসে, ডেলিভারিও হয় স্বাভাবিক গতিতে। অপরদিকে বিদেশে পণ্য পাঠানোও গতিশীল হয়ে উঠে। ১৯টি বেসরকারি আইসিডি থেকে কন্টেনার পরিবহনও স্বাভাবিক গতি পায়। কিন্তু ওই পাঁচ দিনে জমে যাওয়া কন্টেনারের ধকল সামলানো কঠিন হয়ে উঠেছিল। এরই জেরে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে আটকে থাকা কন্টেনারের সংখ্যা কমিয়ে এনে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। বন্দরে স্বাভাবিক সময়ে ৩০/৩১ হাজার টিইইউএস কন্টেনার থাকে।
প্রথম দফার ধাক্কা সামলানোর আগে আবারো চট্টগ্রাম বন্দর সংকটে পড়ে চলতি মাসের ৫ আগস্ট থেকে আবারো অস্থিতিশীল হয়ে উঠে দেশের পরিস্থিতি। আবারো বন্ধ হয়ে যায় বন্দর থেকে কন্টেনার ডেলিভারি। এতে করে বিদেশ থেকে জাহাজে আনা কন্টেনার বন্দর ইয়ার্ডে খালাস করে জড়ো করে রাখা হলেও তা ডেলিভারি হচ্ছিল না। গতকাল সকাল থেকে কাস্টমস এবং ব্যাংকসহ সবকিছু খুলে দেয়া হলেও কার্যতঃ বন্দরের কাজে গতি আসেনি। এর মধ্যে গতকাল দুপুর থেকে নিরাপত্তার দাবিতে কাস্টমসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে অফিস ছেড়ে চলে গেলে আবারো শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে কন্টেনার ডেলিভারি তলানিতে নেমে যায়। বন্দর থেকে কন্টেনার ডেলিভারি না হলেও জাহাজ থেকে স্বাভাবিক নিয়মেই কন্টেনার খালাস করা হয়। যা জড়ো হয় বন্দরের ইয়ার্ডে। এতে করে আগের কন্টেনারের পাহাড় ফুলে ফেঁপে স্বাভাবিক সময়ের স্মরণকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। বন্দরের ইয়ার্ডে সচরাচর ৩০/৩১ হাজার টিইইউএস কন্টেনার থাকে। পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হলে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩৩/৩৪ হাজার টিইইউএস পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। কিন্তু গতকাল তা ৪৪ হাজার ১১৭ টিইইউএস–এ গিয়ে ঠেকে। এরমধ্যে এফসিএল কন্টেনার ৩৭ হাজার ৮০৬ টিইইউএস। এলসিএল কন্টেনার ১ হাজার ২৪২ টিইইউএস, ঢাকা আইসিডিমুখী কন্টেনার ১ হাজার ৯৭০ টিইইউএস, রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার ৬৭১ টিইইউএস, খালি কন্টেনার ২ হাজার ৪০৯ টিইইউএস এবং আইসিটি কন্টেনার ১৯ টিইইউএস।
উল্লেখ্য বন্দরের ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৩১৮ টিইইউএস। ধারণক্ষমতা বেশি থাকায় আটকে থাকা কন্টেনার রাখার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা না হলেও এতো বিপুল সংখ্যক কন্টেনার বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। বিশেষ করে কন্টেনার হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট মুভমেন্টের গতি কমে যায়। যা জাহাজের কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
গতকাল বন্দর থেকে মাত্র ৩২৯ টিইইউএস কন্টেনার ডেলিভারি হয়েছে। যা স্বাভাবিকভাবে ৫ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদিকে গতকাল জাহাজ থেকে খালাস করা হয়েছে ২ হাজার ৪০৯ টিইইউএস, জাহাজে তোলা হয়েছে ১ হাজার ২৬৫ টিইইউএস কন্টেনার। ঢাকা আইসিডিতে একটি কন্টেনারও যায়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কন্টেনারের পাহাড় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এতো বিপুল সংখ্যক কন্টেনারের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ধারণক্ষমতা বেশি থাকায় কিছুটা রক্ষা পেলেও এই বিপুল সংখ্যক কন্টেনারের জট সামলাতে অনেকদিন সময় লেগে যাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ রাতে দিনে কাজ চালাচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কন্টেনার ডেলিভারি নেয়ার জন্য আমদানিকারকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কন্টেনার জট তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে আমাদের ইয়ার্ডে এতো কন্টেনার আটকা পড়ে না। এখন বেশি আটকা পড়েছে। করোনাকালে আমাদের ইয়ার্ডে এমন কন্টেনারের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল।