চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্বৃত্ত অংশ থেকে একটি ভাগ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক) কিভাবে দেয়া যায় কিংবা কী উপায়ে চসিক পেতে পারে তার উপায় খুঁজতে যৌথভাবে আলোচনায় বসবে উভয় সংস্থা। পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার উপর ধার্যকৃত পৌরকর বা হোল্ডিং ট্যাক্স চসিকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনে যৌথভাবে পুনর্মূল্যায়ন এবং ধার্যকৃত পৌরকর পরিশোধ করবে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযোগ আছে এমন খালগুলোর মুখে ‘নেট’ স্থাপনের মধ্য দিয়ে নদীতে বর্জ্য না যাওয়ার ব্যবস্থা করবে চসিক। একইসঙ্গে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কাজ শেখ মুজিব রোডের বাদামতলী মোড় এলাকায় শুরু করার আগে সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন ও সিএমপিকে যৌথভাবে সমন্বয় করতে হবে।
গতকাল সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত ‘কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, দখল ও দূষণ রোধে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়ন, চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন সংক্রান্ত’ আলোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। সভায় উপস্থিত চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বিষয়টি দৈনিক আজাদীকে নিশ্চিত করেছেন।
সভায় চসিক প্রশাসক আর্থিক অক্ষমতার বিষয় তুলে ধরে প্রস্তাব করেন, ‘স্বায়ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্বশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল কর্পোরেরশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাসমূহের তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন, ২০২০ এর ৫নং ধারার আংশিক সংশোধন করে বন্দরের আয়ের উদ্বৃত্ত টাকা চসিকের অনুকূলে যেন বরাদ্দ দেয়া হয়।’ এছাড়া স্থগিত হওয়া পঞ্চবার্ষিকী কর মূল্যায়নে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৬২ টাকা ধার্য করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৯-২০০ অর্থ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় করলেও সিটি কর্পোরেশনকে পৌরকর দিয়েছে ৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শেখ আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকার দিলে আমাদের আপত্তি নেই। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. জাফর আলম কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকা এবং নগরের বিভিন্ন খাল দিয়ে ময়লা-আবর্জনা নদীতে পড়ছেন উল্লেখ করে এ জন্য চসিককে দোষারোপ করেন। পরে এ বিষয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেন, বন্দর চট্টগ্রামের গৌরব। সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এখানে হয়। চট্টগ্রামের উন্নয়নেও বন্দরকে ভূমিকা রাখতে হবে। বন্দরেরও যে রাজস্ব দেয়ার কথা সেটা ঠিকভাবে দিচ্ছে না। শুধু ৩৯ কোটি টাকা কেন, বন্দরের উচিত সিটি কর্পোরেশনকে ৩০০ কোটি দেয়া। এসময় তিনি কর পুনর্মূল্যায়নের পাশাপাশি উদ্বৃত্ত অংশের বিষয়ে যৌথভাবে আলোচনার সিদ্ধান্ত দেন।
এসময় তিনি চট্টগ্রাম বন্দরসহ সেসকল প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা-ঘাটসহ নানা সেবা গ্রহণ করছে তাদেরকে সিটি কর্পোরেশনের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করার আহ্বান জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করায় নগরীর অভ্যন্তরীণ রাস্তা ঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব রাস্তা ঘাট সংস্কার করতে অর্থের প্রয়োজন যা যোগান দেয়া সিটি কর্পোরেশনের একার সম্ভব নয়। তাই সকল প্রতিষ্ঠানকে সঠিক সময়ে সিটি কর্পোরেশনের নিকট রাজস্ব প্রদানের নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, বন্দরসহ সব সংস্থার জয়েন্টলি এসেসমেন্ট করে। জয়েন্টলি ক্যালকুলেট করে। সিটি কর্পোরেশনকে তো বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, পানির সেবা দিচ্ছে না। তাহলে তাদের ন্যায্য দিবে না কেন। এসময় তিনি চসিক প্রশাসকের প্রশংসা করেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সঙ্কট নিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দেখছে। বিশেষ করে কর্পোরেশন চলে জনসাধারণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ট্যাঙের অর্থে। যদি সবাই ট্যাঙ নিয়মিত দেন তাহলে এই আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠত। তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানকেই বিনামূল্যে সরকারি সেবা দেয়া যাবে না। নির্ধারিত ফি পরিশোধ করেই সবাইকে সেবাগ্রহণ করতে হবে। এতে করে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সেবার মানও উন্নত হবে ।
সভায় চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্যুয়ারেজ প্রকল্প সম্পর্কে বলেন, ৬টি ফেজে করা হবে। এর মধ্যে একটি ফেজের কাজ শুরু হবে। একসাথে শুরু করতে না পারার জন্য আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথাও জানান। তখন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, একসাথে না করলে তো কাজ শেষ করতে অনেক সময় লাগবে। অনেক দাতাসংস্থা টাকা দিতে আগ্রহী।
সভার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ যে পৌরকর দেয় তা তাদের আয়ের তুলনায় চেয়ে অনেক। বিষয়টি আমরা তুলে ধরেছি। তখন মন্ত্রী প্রয়োজনে পুনরায় এসেসমেন্ট করা এবং উভয়ে আলাপ-আলোচনা করার সিদ্ধান্ত দেন। এছাড়া উদ্বৃত্ত অংশের বিষয়ে উভয় সংস্থাকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে বলেন।
সুজন আজাদীকে বলেন, বারিক বিল্ডিং মোড়ে ফ্লাইভার করতে গেলে সমস্যা হতে পারে বলে আলোচনা হয়েছে। কারণ সেখানে বঙ কালভার্ট আছে। ফ্লাইওভার করার সময় সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আগ্রাবাদসহ আশেপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়বে। এছাড়া ফ্লাইওভারের কাজের কারণে সৃষ্ট যানজট নিয়েও কথা হয়। তাই এ বিষয়ে সিডিএ, সিএমপি এবং সিটি কর্পোররেশনকে যৌথভাবে বসে ঠিক করার সিদ্ধান্ত দেন। তবে সিডিএ জানিয়েছে বঙ কালর্ভাটের ক্ষতি না করেই কাজ করবে।
সুজন জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ সিটি কর্পোরেশনকে অনুরোধ করে। তখন আমাদের মন্ত্রী মহোদয় প্রয়োজনে খালের মুখে জাল দিয়ে বর্জ্য যেন নদীতে না পড়ে তার ব্যবস্থা নিতে বলেন।
এদিকে সভা শেষে সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প নেয়া আছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে পূর্ত মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সিটি কর্পোরেশনসহ সবাই দায়িত্বপ্রাপ্ত। কাজগুলো সঠিকভাবে করার জন্য, গুণগত মানসম্পন্ন যেন হয়, সঠিক সময়ে যেন হয় সেজন্য সভা হয়েছে। চমৎকার আলোচনা হয়েছে এবং স্ব স্ব দায়িত্ব সবাই বুঝে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। দায়িত্বগুলো পালন করার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের আরো যে সমস্যা আছে সেগুলো চিহ্নিত করা হবে এবং সমাধান করা হবে এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে কোনো সমন্বয়হীনতা থাকবে না। আমি জানি না কখনো সমন্বয়হীনতা ছিল কিনা? এখন আমার নেতৃত্বে সকল মন্ত্রণালয়গুলো এসেছে। যদিও কোথাও আমাকে যেতে হয়, সেখানে আমি যাব। সবাই মিলে কাজ করছি বাংলাদেশের জন্য। তিনি বলেন, চট্টগ্রামকে একটি উন্নত নগরীতে পরিণত করার জন্য আমাদের প্রশাসক যাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করছেন। তাতে দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে। যেসব রাস্তাঘাটগুলোর ভগ্নদশা ছিল সেগুলো এখন ভালো অবস্থার দিকে যাচ্ছে। আরো অন্যান্য যেসব কাজ আছে সেগুলোও হবে। খালগুলো পরিষ্কার করা হবে, কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং করা হবে।