এক লাফে অনেক বেড়ে যাওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফের হার এক মাসের জন্য পিছিয়ে দেওয়া কথা বলেছেন নৌ পরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। গতকাল শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর মিলনায়তনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত এক কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, শুল্ক নিয়ে কথা হচ্ছে, এটি আরও এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা সম্মত হয়েছি, এক মাস পিছিয়ে দেব। কোন সময় থেকে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, এখন থেকেই আরও এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ইআরডি এদিন ‘কাস্টমস ও বন্দর ব্যবস্থাপনা : সম্ভাবনা, সমস্যা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এ কর্মশালার আয়োজন করে, যাতে বন্দর সংশ্লিষ্টরা অংশ নেন। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে তা পরদিন থেকে কার্যকর করা হয়। নতুন হারে ট্যারিফ নির্ধারণের প্রস্তাবের পর থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তবে তাদের আপত্তি আমলে না নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অর্থ বিভাগ অনুমোদন করে। পরে প্রজ্ঞাপন জারি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। খবর বিডিনিউজের।
ব্যবসায়ীদের দাবি, এমন উচ্চহারে ট্যারিফ আরোপ করা হলে ভোক্তা পর্যায়ে এর চাপ পড়বে। তারা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন। তবে বন্দরের ভাষ্য, ১৯৮৬ সালের পর এবার ট্যারিফ বাড়ানো হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানকে হিসাবে নিলে ট্যারিফ খুব বেশি বাড়ছে না।
চলতি বছরেই চূড়ান্ত হচ্ছে ন্যাশনাল পোর্ট স্ট্র্যাটেজি : বাসস জানায়, কর্মশালায় নৌ পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, দেশের স্থল, নৌ ও সমুদ্র বন্দসমূহের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ন্যাশনাল পোর্ট স্ট্র্যাটেজি শীর্ষক একটি জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করছে। তিনি বলেন, ন্যাশনাল পোর্ট স্ট্র্যাটেজির খসড়া প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি এ বছরের মধ্যেই এই স্ট্র্যাটেজি চূড়ান্তকরণের কাজ শেষ হবে।
নৌ উপদেষ্টা বলেন, আমদানি–রপ্তানিকৃত পচনশীল পণ্যদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য সরকারের মোংলা বন্দরে একটি কোল্ড চেম্বার করার পরিকল্পনা রয়েছে। সঠিকভাবে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে মোংলা বন্দরকে একটি আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. ইউসুফ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান এবং চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার নুসরাত সুলতানা। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন ইআরডি সচিব মো. শাহ্রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী সমুদ্র বন্দরসমূহের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বর্ধিত ট্যারিফ প্রসঙ্গে নৌ পরিবহন সচিব বলেন, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের বিভিন্ন শর্তাবলি মেনে চলতে হবে। সমুদ্র বন্দরসমূহের দক্ষতা বৃদ্ধি করতেও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। বিনিয়োগের জন্য এই ধরনের মাশুল হতে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহৃত হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, বন্দরে কাস্টমস সংক্রান্ত প্রক্রিয়া আরও গতিশীল করার জন্য সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে সমুদ্র বন্দরসমূহে কন্টেনার স্ক্যানার চালু করা হয়েছে এবং অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
ইআরডি সচিব মো. শাহ্রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে পরিবেশগত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শর্তাবলি মেনে চলতে হবে। উত্তরণের প্রেক্ষাপটে দেশের মানবসম্পদের দক্ষতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে কোনো ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি হলে যাতে বড় ধরনের সমস্যা না হয় এবং বড় জাহাজ যাতে সহজে বন্দরে প্রবেশ করতে পারে সেই লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প একটি গভীর সমুদ্র বন্দর থাকা প্রয়োজন। বন্দরে পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
কর্মশালার মূল বিষয়বস্তুর ওপর একটি উপস্থাপনা প্রদান করেন সাবেক সচিব ও ইআরডির এসএসজিপি প্রকল্পের প্রকল্প উপদেষ্টা আবদুল বাকি। তিনি বন্দরে পণ্য চালানের সময় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বেসরকারি খাতের অপারেটরসমূহ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ কাস্টমস ও অন্যান্য সরকারি–বেসরকারি সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
কর্মশালায় প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য রাখেন এনবিআর সদস্য ড. মো. আল আমিন প্রামানিক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য কমডোর আহমেদ আমিন আবদুল্লাহ এবং চৌধুরী গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (শিপিং) শাহেদ সারওয়ার। তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও কাস্টমসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াসমূহ পূর্ণ ও কার্যকররূপে স্বয়ংক্রিয়করণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
কর্মশালায় উদ্বোধনী বক্তব্য প্রদান করেন ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও এসএসজিপি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এএইচএম জাহাঙ্গীর। আলোচকবৃন্দ চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য সম্প্রতি আরোপিত বর্ধিত ট্যারিফ পুনর্বিবেচনা এবং সমুদ্র বন্দরের অফ ডকের ধারণক্ষমতা আরও বৃদ্ধির আহ্বান জানান। তারা চট্টগ্রাম বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকার রাস্তাঘাট মেরামত ও অন্যান্য অবকাঠামো শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করার জন্য আহ্বান জানান।