বনবিভাগের জব্দ বালু ফের জব্দ দেখিয়ে নিলামে তুলছেন ইউএনও

‘বনবিভাগ কী বলছে তা আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই’

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া | শনিবার , ৩০ মার্চ, ২০২৪ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের পেকুয়ায় সংরক্ষিত বনের ভেতর বালুদস্যু সিন্ডিকেটের অবৈধভাবে উত্তোলিত ৪ লক্ষ ৬ হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করে বনবিভাগ। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে পরিবেশের ক্ষতি সাধনের দায়ে বন আইনে মামলাও রুজু করে বনবিভাগ। অভিযোগ উঠেছে, ২০২৩ সালের ২৫ মে বারবাকিয়া রেঞ্জের টৈটং বনবিটের মধুখালী (চকরিয়ার হারবাং রিজার্ভ এলাকা) সংরক্ষিত বনের গহীন জঙ্গল থেকে ওই বালু জব্দ করেন বিট কর্মকর্তা জমির উদ্দিন। বনবিভাগের জব্দকৃত সেই বালু সম্প্রতি ফের ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক জব্দ দেখিয়ে তা নিলামে বিক্রির জন্য দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন নব যোগদানকৃত পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম। এ নিয়ে বনবিভাগের সাথে ইউএনওর দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।

বনবিভাগ জানায়, সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে বনবিভাগের জব্দকৃত বালু বিক্রির জন্য নিলাম প্রক্রিয়া শুরু না করতে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে একটি পত্রও দেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক দেওয়া সেই দাপ্তরিক পত্রে রেঞ্জ কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে জব্দকৃত বালু যদি বের করা হয়, তাহলে সংরক্ষিত বনের ভেতরকার জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। এছাড়াও সংরক্ষিত বনের কোনো কিছু নিলাম দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন নিতে হয়। মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রশাসনিক অনুমোদন ব্যতিরেকে আগ বাড়িয়ে কোনো কিছুই করা যাবে না।

বনবিভাগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছেযে সিন্ডিকেট সংরক্ষিত বনের ভেতর শ্যালোমেশিন ও ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেছে, তারা দাগি অপরাধী। সেখানে হত্যা মামলার আসামির পাশাপাশি একাধিক বন মামলার আসামিও রয়েছে। মূলত এসব অপরাধীর ইন্ধনেই পেকুয়ার ইউএনও’র মাধ্যমে বনবিভাগের জব্দকৃত বালু নিলামে তুলে মোটা অংকের টাকা ভাগবাটোয়ারা করার চেষ্টা করছে প্রভাবশালী একটি চক্র। এসব বিষয় ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় এবং বনবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে।

পেকুয়ার ইউএনও কর্তৃক বনবিভাগের জব্দকৃত বালু নিলামে তোলার প্রক্রিয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকতা হাবিবুল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বনবিভাগের জব্দকৃত বালু চাইলেই উপজেলা প্রশাসন নিলামে তুলতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু গায়ের জোরে পেকুয়ার ইউএনও বনবিভাগের জব্দকৃত বালু নিলামে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যা কোনো অবস্থাতেই বন আইনের মধ্যে পড়ে না।’

রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, ‘টৈটং বনবিটের নিয়ন্ত্রণাধীন সংরক্ষিত বনের মধুখালী এলাকায় যেসব বালু জব্দ করা হয়েছে সেই স্থানটি চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নেরও অধীন। এসব কিছুর পরেও পেকুয়ার ইউএনও আমাকে মোবাইল ফোনে জানান যে, বনবিভাগ কর্তৃক মধুখালী এলাকায় জব্দকৃত বালুর স্তুপ পরিদর্শনে যাবেন। এর পর পরিদর্শন শেষে সেই বালু নিলামে তোলার প্রক্রিয়া গ্রহণ করবেন। এই বিষয় জানার পর আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সেই বালু নিলামে না তুলতে আমার দপ্তর থেকে একটি পত্রও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক বিধির তোয়াক্কা না করে ইউএনও সেই বালু নিলামে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। এখন যদি বালুগুলো বের করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয় তাহলে সংরক্ষিত বনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হওয়াসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে।’

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ব্যতীত সংরক্ষিত বনের কোনো কিছুই নিলাম দেওয়া যায় না। এর পরও গায়ের জোরে কিছু করতে চাইলে তা রীতিমতো বনবিভাগের সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্বের শামিল।যোগ করেন রেঞ্জ কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় পরিবেশসচেতন একাধিক ব্যক্তি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বনবিভাগ কর্তৃক জব্দকৃত বালুগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক কোটি টাকা। কিন্তু ইউএনওকে হাত করে বালুদস্যুরা সেই জব্দকৃত বালু নামেমাত্র মূল্যে হাতিয়ে নেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। এজন্য কম মূল্যে নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে একটি বালুদস্যু সিন্ডিকেট কাজ শুরু করেছে।’

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকতা (ডিএফও) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বিভাগীয় মামলামূলে সংরক্ষিত বনের ভেতর বন বিভাগের জব্দকৃত বনজদ্রব্য দ্বিতীয়বার অন্য কেউ জব্দ করতে পারবে না। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে বিধি মোতাবেক নিলামে তোলা যাবে। বন আইনে এটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) বিপুল কৃষ্ণ দাস দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বনবিভাগের জব্দকৃত বালু চাইলেও অন্য কোনো সরকারি দপ্তর নিলামে তুলতে পারে না। এই বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলার জন্য ডিএফওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

সংরক্ষিত বনের ভেতর বনবিভাগ কর্তৃক বিভাগীয় মামলা রুজুসহ জব্দকৃত বালু দ্বিতীয়বার জব্দ করাসহ নিলামে তোলার প্রক্রিয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলামের। এ সময় তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমেই বালুগুলো জব্দ করা হয়েছে। এ নিয়ে বনবিভাগ কী বলছে, না বলছে তা আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই আগামী সপ্তাহে এসব বালু নিলামে তোলা হবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপটকাবাজির আগুনে পুড়ল স্কুল
পরবর্তী নিবন্ধআধুনিকায়নে ২২৩ কোটি টাকার প্রকল্প