বদ্বীপটির নাম হল বাংলাদেশ

সালমা বিনতে শফিক | বুধবার , ৩০ মার্চ, ২০২২ at ১:৩৫ অপরাহ্ণ

আজ থেকে একান্ন বছর আগেও ‘বাংলাদেশ’ নামে কোন রাষ্ট্র ছিল না পৃথিবীর বুকে। সবুজের বুকে লাল বৃত্ত আঁকা যে পতাকা ওড়াই আমরা বিশেষ বিশেষ দিনে সেই পতাকাটাও ছিল না। আমাদের জন্য এই পতাকা আনতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল বাংলা মায়ের তিরিশ লক্ষ সন্তান। ঊনিশশো একাত্তর সালের কথা। রাষ্ট্র হল, পতাকা হল, পৃথিবীর বুকে আমাদের একটা পরিচয়ও হল। এই পরিচয় আত্মমর্যাদার, এ পরিচয় গৌরবের।
তবে বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু কেবল এই অর্ধশতকের নয়। আমাদের ইতিহাস হাজার বছরের। একেক সময়য় একেক নামে ডাকা হত আমাদের এই ভূখণ্ডকে। হাজার নদী এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে এর শিরা শিরায়। পাহাড় আছে কোথাও কোথাও। একেবারে দক্ষিণে বিশাল সমুদ্র- বঙ্গোপসাগর। নদী সাগর পালা করে ধুয়ে দিয়ে যায় দেশের মাটি। এ-কুল ভাঙে ও-কুল গড়ে। নরম মাটিতে সোনা ফলে। এখানকার মানুষগুলো বরাবর খুব সহজ-সরল আর শান্তিপ্রিয় । কেউ কৃষিকাজ করে, কেউ নৌকা বায়, মাছ ধরে, কেউবা তাঁত বোনে। আরও অনেক কাজ। তবে সবার মুখে থাকে হাসি আর গান। নাচে গানে হাসি আনন্দে কেটে যায় দিনগুলো।
অন্য দেশের মানুষরা জানে আমাদের হাসি আনন্দ ভরা দেশটার কথা। কেউ কেউ দেখতে আসে, আবার কেউবা আসে লুটপাট করতে। ভিনদেশী দস্যুরা ধনসম্পদ ছিনিয়ে নেয় সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে। একসময় রাজাকে তাড়িয়ে নিজেরাই বসে পড়ে রাজার আসনে। কদিন পর আসে অন্য এক দেশের দস্যু। একদল আসে, একদল যায়। এভাবে কতবার হাতবদল হয় দেশের চাবি!
দেশের মানুষের মনে অনেক দুঃখ। তবুতো গান আছে গলায়, কথা আছে মুখে, কারণ ভাষাটা তখনও কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। সেই প্রাণের ভাষা, আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা; পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষা। কিন্তু একদিন এই ভাষার ওপরেও আঘাত এল। ভিনদেশী দস্যুরা, যারা রাজার আসনে বসে দেশের সব লুট করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাচ্ছিল, তারা ঘোষণা দিয়ে বসে- এখন থেকে বাংলায় কথা বলা যাবে না। – এ কেমন কথা ! ভাষা কেড়ে নিলে আমরা বাঁচব কী করে!
গর্জে ওঠে ছাত্র জনতা। তখন ঊনিশশো বাহান্ন সাল। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়। দস্যু রাজার নির্দেশে গুলি ছোঁড়া হয় মিছিলে। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে অনেক যুবক। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরের নামই কেবল জানি আমরা। আরও অনেকে হারিয়ে যায় সেদিন। সবার রক্তে লাল হয় ঢাকার পথঘাট। এতো রক্ত আর মৃত্যু দেখে ভিনদেশী দস্যুরাও ভয় পেয়ে যায়। ওরা বুঝতে পারে সবকিছু কেড়ে নিলেও ভাষা কেড়ে নেওয়া যাবে না এদেশের মানুষদের মুখ থেকে। বাহান্ন সালের আগুন ঝরা ফাগুনের এক দুপুরে ‘বউ কথা কও’ পাখির ডাক শুনে সত্যিই ঘাবড়ে যায় ভিনদেশী সেনা। যে দেশে পাখি ডাকে বাংলায়, সেদেশে মানুষতো বাংলা বাঁচাতে জীবন দেবেই।
ঠিক তাই। জীবন দিয়ে, অনেক দাম দিয়ে বাংলা বাঁচান হল। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা হল। কিন্তু মাটি? মাটিকে শত্রুমুক্ত, দস্যুমুক্ত না করলেতো মানুষের মতো বাঁচা যায়না। তাই এবার শুরু বাঁচার লড়াই। লড়াই মানে সংগ্রাম, লড়াই মানে যুদ্ধ। বাঁচার মতো বাঁচতে হলে সবার আগে চাই মুক্তি। এই মুক্তি পরাধীনতা হতে, অপশাসন হতে, বৈষম্য হতে। সব মানুষ সমান, কেউ কাউকে অসম্মান করবে না, রাজারা বেশী শক্তিশালী হয়ে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করবে না- এইটুকুই স্বপ্ন ছিল সাধারণ মানুষের।
এমন সময় শোনা যায় একটি বজ্রকন্ঠ। কণ্ঠটি যাঁর, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। সবাই তাঁকে ভালোবেসে ডাকে বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই ছোট্ট সাধারণ স্বপ্ন পূরণের জন্য হুংকার ছাড়েন। সবাইকে তৈরি থাকতে বলেন। কী জন্য তৈরি থাকতে? রক্ত দিতে, প্রাণ দিতে। কী ভয়ানক দুঃসাহসী সেই ভাষণ! তখন ঊনিশশো একাত্তর। সেদিন ছিল মার্চ মাসের সাত তারিখ।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে লক্ষ লক্ষ মানুষ; কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী- সকল পেশার মানুষ। তরুণ যুবক তো ছিলই, অনেক কিশোরও যুদ্ধে নামে দেশকে বাঁচাতে। অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দস্যুদের শেষ করে করে একেকজন হয়ে ওঠে দক্ষ সৈনিক। তবে সবাই কিন্তু বীরের মতো ঘরে ফিরে যেতে পারেনি। অনেকে হারিয়ে যায় চিরতরে। ফিরে এসেও অনেকে দেখে- ওদের ঘর নেই, নেই বাবা মা ভাই বোন। কারণ দস্যুরা সব ছিনিয়ে নিয়েছে। অনেকে আবার পালিয়ে গিয়েছে পাশের দেশে। কী দুঃসহ সেই যাত্রাপথ!
মার্চ থেকে ডিসেম্বর নয়টি মাস তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, আমাদের দেশটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়েও ক্লান্ত হয় না দস্যুরা। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ ধীরে ধীরে জানতে পারে নিষ্ঠুর সেই ধ্বংসজজ্ঞের কথা। সবাই নিন্দা জানায়, গণহত্যা বন্ধ করার দাবী জানায়। অনেকে দুর্গত মানুষদের সাহায্য করার জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। পৃথিবীর নামকরা শিল্পীরা অসহায় মানুষদের খাবার ও চিকিৎসার খরচ যোগাতে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন। নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসনদের কনসার্টের কথা সবাই জানে।
ডিসেম্বরের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ার দশ জন মানবতাবাদী কর্মী ক্যানবেরা থেকে পায়ে হেঁটে মেলবোর্ন গিয়েছিলেন অর্থ সংগ্রহের জন্য। ফ্লিণ্ডারস স্ট্রিট রেলওয়ে স্টেশনের সামনে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে সেদিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র ছাত্রী উপস্থিত ছিল। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক উইলিয়াম ওউডারল্যান্ডতো ঢাকায় এসে গেরিলাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে যুদ্ধেই নেমে গিয়েছিলেন।
একে একে পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ সমর্থন জানাতে থাকে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি। ভিনদেশী দস্যুরা বুঝতে পারে তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। বঙ্গোপসাগরের উপকুলের এই ছোট্ট বদ্বীপ ওদের জন্য আর নিরাপদ নয়। ওদের ফিরে যেতে হবে নিজের দেশে। ডিসেম্বরের ষোল তারিখ অবশেষে হার মানে তারা। পরাজয় স্বীকার করে মাথা নত করে চলে যায় আমাদের মাটি ছেড়ে।
সেদিন প্রতিষ্ঠা হয় মাটির অধিকার। অবশেষে বাংলা বাঙালীর হয়। বঙ্গোপসাগরের কোলের ছোট্ট এক বদ্বীপ সেদিন ‘বাংলাদেশ’ নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে পৃথিবীর বুকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছোট্ট পাখি টুনটুনি
পরবর্তী নিবন্ধউত্তর জেলা ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল