এই গ্রহের সবচেয়ে বড় প্রাণী নীল তিমি বাস করে আমাদের বঙ্গোপসাগরেও। নীল তিমি আকারে ৯৮ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ এবং ওজনে ১৮১ টন পর্যন্ত ভারী হতে পারে। প্রায় এক হাজার মাইল দূর থেকেও শোনা যায় তাদের ডাক। ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ১০ প্রজাতির নীল তিমি শনাক্ত হয়েছে। যারমধ্যে অধিকাংশ প্রজাতির তিমিই বঙ্গোপসাগরে বিচরণ করে বলে জানান বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পিএইচডি ফেলো মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের অংশ। তাই ভারত মহাসাগরের প্রজাতিগুলো আমাদের বঙ্গোপসাগরেও বিচরণ করবে- এটা স্বাভাবিক। তবে বঙ্গোপসাগরে এ পর্যন্ত কত প্রজাতির তিমি শনাক্ত হয়েছে জানতে চাইলে তা নিয়ে দেশে কোনো গবেষণা হয়নি বলে তিনি জানান।
একই তথ্য জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। তিনি জানান, বঙ্গোপসাগরে কত প্রজাতির তিমি পাওয়া যায় তা নিয়ে এখনও জরিপ হয়নি। তবে হামব্যাক হুয়েল (ঐঁসঢ়নধপশ ডযধষব) ও ব্রাইডস হুয়েলসহ (ইৎুফব’ং ডযধষব) ৩/৪টি প্রজাতির তিমি এখানে বেশি দেখা যায় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজার শহরতলীর হিমছড়ি ৫নং ব্রিজ সংলগ্ন সৈকতে সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে ভেসে আসা ৪৪ ফুট দীর্ঘ মরা নীল তিমিটিও ব্রাইডস হুয়েল প্রজাতির বলে জানান মৎস্য বিজ্ঞানীদ্বয়। এর আগে ১৯৯০ সালে কক্সবাজার শহরের লাবণী পয়েন্ট সৈকতে ভেসে এসেছিল একটি মরা তিমি, যেটি ছিল আকারে আরো বড়।
বিজ্ঞানীরা জানান, প্রাণীদের মধ্যে তিমিই সবচেয়ে জোরে আওয়াজ করতে পারে। শুনতে দীর্ঘ ‘মমমমমমমমমমমম’ লয়ের বা ছন্দের এই আওয়াজ সৃষ্টির মাধ্যমে তিমিরা নিজেদের ভেতর যোগাযোগ করে থাকে। যেখানে একটা জেট ইঞ্জিনের শব্দের মাত্রা থাকে ১৪০ ডেসিবল, সেখানে নীল তিমির আওয়াজের মাত্রা হয় ১৮৮ ডেসিবল, যা প্রায় এক হাজার মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। তিমির এই আওয়াজকে অনেকে গান হিসেবে বিশেষায়িত করে থাকে।
নীল তিমির জিভের ওজন একটা হাতির ওজনের সমান পর্যন্ত হয়। আর এর হৃদযন্ত্রের ওজনও একটা গাড়ির সমান হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক একটি নীল তিমি ৮২ থেকে ৯৮ ফুট পর্যন্ত বড় হতে পারে। জন্মানোর সময় নীল তিমির বাচ্চার আকৃতি হয় প্রায় ২৫ ফুটের কাছাকাছি। তার মানে গড় উচ্চতার চারটি মানুষের চেয়েও দীর্ঘ। একটা নীল তিমির ওজন ১৮১ মেট্রিক টন পর্যন্ত হতে পারে। যা ১৫টি পূর্ণবয়স্ক হাতির সমান। বিশাল এই দৈত্যের খাবারও দৈত্যাকার হওয়ার কথা, তবে তা কিন্তু হয়নি। নীল তিমি দিনে ৪ থেকে ৮ টন ক্রিল খেতে পারে। ক্রিল হল ফ্যাকাশে গোলাপি রঙের একপ্রকার সামুদ্রিক পতঙ্গ, যেগুলো আকারে বড়জোর একটি আঙুলের সমান হয়ে থাকে। তিন থেকে ছয় কোটি ক্রিল একসঙ্গে দাঁড়িপাল্লায় রেখে ওজন করলে তিমির এক দিনের খাবারের ওজনের সমান হবে।
বিশালাকার এই প্রাণীটির দাঁত নেই। আছে ব্যালিন, যা দেখতে অনেকটা ঝালরের মতো। এই ব্যালিন ফিল্টারের কাজ করে। উপরের চোয়াল থেকে নিচের চোয়াল পর্যন্ত ঝুলে থাকে এই ব্যালিন। তিমির মোট ৩০০ ব্যালিন প্লেট থাকে, যার একেকটির দৈর্ঘ্য তিন ফিটেরও বেশি।
নীল তিমির খাবার গ্রহণের ধরনও বেশ অদ্ভূত। এই মাছটি যখন সাগরের বুকে এঁকেবেঁকে চলতে থাকে, তখন সে এক গ্রাসেই খেয়ে নেয় হাজারো ‘ক্রিল’। নীল তিমির গলার চামড়ায় প্রায় ৮৮টির মতো ভাঁজ থাকে। খাবার গ্রহণের সময় হাঁ করলেই সব ভাঁজ খুলে যায় এবং মুখটা বিশাল বেলুনের মতো হয়ে যায়। হাঁ করে নীল তিমি লোনা পানিসহ একবারে হাজার হাজার ক্রিল মুখের ভেতর টেনে নেয়। তারপর সেই পানি ব্যালিনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করে দেয়। যার ফলে ক্রিলগুলো ব্যালিনে আটকে যায় এবং পানি বেরিয়ে যায়। পানি বের হওয়ার পর ক্রিলগুলো একত্রে জমা হয় এবং তা গিলে ফেলে ভোজন সম্পন্ন করে নীল তিমি। তবে মজার ব্যাপার হলো নীল তিমি মোটেই নীল নয়। পানির নিচে থাকলে নীল মনে হয় বলে এরা নীল তিমি নামেই পরিচিত। আসলে এদের রং অনেকটা ফ্যাকাশে।
তিমিরা সাধারণত ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে চলাচল করে। তবে কখনো তাদের ছোটার গতি ২০ মাইলের কাছাকাছিও হয়। নীল তিমি বাতাসে একবার শ্বাস নিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পানির নিচে থাকতে পারে। ৩০ মিনিটের ভেতরে তাই পানির নিচ থেকে উপরে উঠে শ্বাস নিতে হয় নীল তিমিকে। জুরাসিক যুগে বিলুপ্ত (১৪ কোটি থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে) দৈত্যাকার প্রাণী ডাইনোসরের চেয়েও বড় এই নীল তিমি। এরা গড়ে ৮০ থেকে ৯০ বছর বেঁচে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকা নীল তিমিটার বয়স ছিল ১১০ বছর। এরা সাধারণত তিন বছরে একবার একটা বাচ্চা প্রসব করে।
নীল তিমির সাধারণত দুটি মৌসুম থাকে। একটি খাওয়ার মৌসুম, অপরটি প্রজনন মৌসুম। খাওয়ার মৌসুম সাধারণত শুরু হয় গ্রীষ্মকালে। উত্তর মেরুতে যখন শীতকাল, দক্ষিণ মেরুতে তখন গ্রীষ্মকাল। মেরু অঞ্চলে যখন শীত থাকে, সেই পুরো সময়টা তখন বিষুবরেখার কাছাকাছি উষ্ণ সাগর অঞ্চলে কাটিয়ে দেয় নীল তিমি। উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের সাগরে গ্রীষ্মকালে কোটি কোটি ক্রিল থাকে। এ সময় তারা প্রচুর পরিমাণে ক্রিল খায় এবং প্রজনন মৌসুমের জন্য শরীরে শক্তি জমা করে রাখে। কারণ শীতকালে তারা খুব কম খাদ্য গ্রহণ করে এবং এ সময় তাদের শরীরে পুরু চর্বির আস্তরণ তৈরি হয়।
নীল তিমিরা সাধারণত শরৎকালের শেষ দিক থেকে তাদের সঙ্গী খোঁজে এবং মিলিত হয়। মিলিত হওয়ার এই মৌসুম থাকে শীত পর্যন্ত। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে তারা নতুন বাসস্থানের খোঁজে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। এ সময়ই সঙ্গীর দেখা পায় তারা। এরপর তারা আবার গ্রীষ্মকালে উষ্ণ সাগরে ফিরে যায় সন্তান জন্ম দিতে।
নীল তিমি অনেকটা জেগে থেকেই ঘুমায়। মানে সে কখনো পুরোপুরি ঘুমায় না। তার মস্তিষ্কের অর্ধেক ঘুমায়, বাকি অর্ধেক জেগে থাকে। কারণ হিসেবে মনে করা হয়, তিমি যদি ঘুমিয়ে পড়ে এবং সময়মতো না জাগে তাহলে দম আটকে মারাও যেতে পারে। তাই তাদের অর্ধেক মস্তিষ্ক সবসময় জেগে থাকে, যাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ঘুমের মধ্যেও ভেসে উঠতে পারে। ঘুমের এ বিষয়টি বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন ইলেক্ট্রো এনসেফালোগ্রাফির (ইইজি) মাধ্যমে।
নীল তিমিকে খুব কমই দলবদ্ধভাবে ঘুরতে দেখা যায়। তারা বেশির ভাগ সময় একা ঘুরতেই পছন্দ করে। পৃথিবীর প্রায় সব মহাসাগরে এরা রাজার মতো ঘুরে বেড়ায়। ভারত মহাসাগর, অ্যান্টার্কটিকা মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের নিউ ফান্ড ল্যান্ড, নোভা স্কশিয়া, গ্রিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডে নীল তিমি দেখা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরে কোরিয়ান কিছু উপ-দ্বীপের কাছে দেখা যায়। আবার দক্ষিণ গোলার্ধে অ্যান্টার্কটিকা, ওশেনিয়া মহাদেশেও দেখা যায় নীল তিমিদের। তবে অতিরিক্ত শিকারের কারণে বিশ্বব্যাপী নীল তিমির সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে কয়েক বছর ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন পরিবেশবাদীরা।
১৯ শতকের প্রথম দিকে প্রায় প্রত্যেক মহাসাগরে নীল তিমি দেখা যেত। এক শতকের ব্যবধানে শিকারিদের উৎপাতে এই প্রাণীটি এখন বিলুপ্তির পথে। ১৯০০ সালের দিকে নীল তিমির তেল সংগ্রহে মানুষের আগ্রহের কারণে বিপুলসংখ্যক নীল তিমি নিধন করা হয়। ১৯০০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার তিমি শিকারিদের হাতে মারা যায়। এরপর আন্তর্জাতিক তিমি কমিশন বাণিজ্যিকভাবে নীল তিমি শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা আইইউসিএন নীল তিমিকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। শিকার ছাড়াও জেলেদের হাতে তিমি নিধন হয়। তিমি জেলেদের জালে আটকা পড়ে ডুবে যায় অথবা অভুক্ত থেকে শেষে মারা যায়। সমুদ্রে জাহাজ যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুতগামী জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েও অনেক তিমি মারা যায়।
২০০২ সালের এক হিসাব মতে, সারা বিশ্বে অন্তত ১২ হাজার নীল তিমি রয়েছে। আইইউসিএন ধারণা করছে, বর্তমানে এর সংখ্যা হতে পারে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার।