বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, যিনি আমাদের বঙ্গমাতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর নাম। বঙ্গবন্ধু তাঁকে রেণু বলে ডাকতেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রভাবশালী মহীয়সী নারী। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সংকটের সঙ্গী, জীবনের চালিকাশক্তি। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ছিলেন না, ছিলেন বন্ধু, পরামর্শক, সহায়ক ও সকল প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধুর যে তিনটি বই আমরা পেলাম, দেখা গেলো সেই বই লেখার নেপথ্যেও ছিলেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।” বললাম, “লিখতে যে পারি না, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।” সে প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘…আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু– আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছিল। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’
বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু, সম্মান করতেন, বিভিন্ন কাজের মর্যাদা দিতেন, তাঁর ওপর অনেকটা নির্ভরও করতেন। বঙ্গমাতা বেগম মুজিব এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর তুলনা করা যায় না। তিনি বাঙালি জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। এমনকি দলের নেতা না হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন তখন তিনি সাহসী ও বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনীতিতে স্মরণীয় সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব হতো, যদি বেগম মুজিব তার সঙ্গে না থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর সেই সংগ্রামী জীবনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা ছিলেন ছায়াসঙ্গী। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন।
বেগম মুজিবের আরেকটি সিদ্ধান্তকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করেন ইতিহাসবিদরা। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধু তার দলের সদস্যদেরও বিভিন্ন কথা তাঁর মনে একধরনের বিভ্রান্তি ও চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই কোমলমতি, স্নেহময়ী নারী তখন সময়ের প্রয়োজনে হয়েছেন কঠিন ও বিচক্ষণ। এরূপ একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ তিনি সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বক্তব্য কী হবে, সে সম্বন্ধে এর পূর্বে নানাজন তাঁকে লিখিত–অলিখিত নানা পরামর্শ দিতে থাকেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও একটানা ৩৬ ঘণ্টার এক বৈঠকে মিলিত হয় মর্মে জানা যায়। কিন্তু বৈঠকে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত না হওয়ায় উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনায় যা বলা আবশ্যক তাই বলবেন বলে বঙ্গবন্ধু নিজের উপর দায়িত্ব তুলে নেন। এক্ষেত্রে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব–এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য : ‘সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে… অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে … তুমি নিজে যে ভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে। (সূত্র : শেখ হাসিনা ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ : কিছু স্মৃতি’, আবদুল ওয়াহাব (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইতিহাস ও তত্ত্ব, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০১৪)। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তিনি অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শেখ মুজিব থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ না হলেও, তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণ, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল নারী। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী