বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য

নেছার আহমদ | রবিবার , ১২ মার্চ, ২০২৩ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী) ১০ লক্ষাধিক জনতাকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক এক ভাষণ প্রদান করেন যা ৭ মার্চের ভাষণ হিসেবে সুপরিচিত। এ ভাষণ নিছক কোনো জনসভার ভাষণ ছিল না। এটি ছিল বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত জাতির উদ্দেশ্যে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবুর রহমানের চূড়ান্ত পর্বের লড়াইয়ের উদাত্ত আহ্বান। ৭ মার্চ ছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য কী হবে সে সম্বন্ধে এর পূর্বে অনেকে লিখিতঅলিখিত নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও একটানা ৩৬ ঘণ্টার বৈঠকে মিলিত হয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়ার উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় যা বলা আবশ্যক তাই বলবেন বলে বঙ্গবন্ধু নিজের উপর দায়িত্ব তুলে নেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য,

…..সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে …. অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে…. তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে’। (শেখ হাসিনা ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ : কিছু স্মৃতি’ আব্দুল ওয়াহাব (সম্পাদিত) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইতিহাস ও তত্ত্ব, মওলা বার্দাস, ঢাকা২০১৪, পৃঃ৯১৯২)

‘‘বঙ্গবন্ধু তাঁর কোনো লিখিত বক্তৃতা নয়, আত্মোপলদ্ধি থেকে তিনি এই জয়গান শুনিয়েছেন। এ ভাষণের পর ‘নিউজউইক’ বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ আখ্যা দেয়। বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা দিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, মনোবল যুগিয়েছেন আমার স্নেহময়ী মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুনেসা মুজিব। যিনি নিভৃতে থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলন পরিচালিত করেছেন।” [শেখ হাসিনা লিখিত ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ, এক অবিস্মরণীয় দিন]

অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে রেসকোর্সের সভামঞ্চে এসে তিনি উপস্থিত হলেন। পেছনে তাঁর বাঙালির হাজার বছরের মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রাম স্বপ্ন। তাই আমেরিকার বর্ণবৈষম্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রিয় নেতা, বিশ্বনন্দিত মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯১৯৬৮) এর মতো জনগণকে শুধু একটি ‘স্বপ্নের কথা’ বলতে নয়, বাঙালির স্বপ্নপূরণ তথা স্বাধীনতা অর্জনে সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানাতে তিনি এলেন। সংক্ষিপ্ত তাঁর ভাষণ। অসাধারণ এর বক্তব্য। যেমনি সারগর্ভ, ওজস্বী ও যুক্তিযুক্ত, তেমনি তির্যক, তীক্ষ্ণ ও দিকনির্দেশনাপূর্ণ। অপূর্ব শব্দশৈলী, বাক্যবিন্যাস ও বাচনভঙ্গি। একান্তই আপন, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যেমন, ‘আমাদের আর দাবায়ে (দাবিয়ে বা দাবাইয়া নয়) রাখতে পারবা না’। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণেপাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালিদের অবস্থা ব্যাখা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরা, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি বাখ্যা ও বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা, সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ সংগ্রাম শেষষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেওয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যেকোনো উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পরামর্শদান ইত্যাদি বক্তব্যের পর ঘোষণা করেন ‘…..মোকাবেলা করতে হবে…. এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত।

এ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অসমান্য দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে বাঙালি জাতিকে বিশ্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। বাঙালি জাতির ওপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অযুহাত পেতো। অপরদিকে আন্দোলনের জোয়ারে স্বাধীনতা ঘোষণার কম কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট করা যাবে না। জাতির পিতা বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’।

এই কঠিন সময়ে এত ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। একেই বলা হয় ভিশনারী লিডার।

আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিকবেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field, ‘We Shall Fight on the Beaches : The Speeches That Inspired History’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসিডোনিয়া, প্রাচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার (রোম), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (ফ্রান্স), যোসেফ গ্যারিবোল্ডি (ইতালি), আব্রাহাম লিংকন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ভ্লাদিমির লেনিন (রাশিয়া), ইউড্রো উইলসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), উইনস্টন চার্চিল (যুক্তরাজ্য), ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস দ্য গল (ফ্রান্স), মাওসেতুং (গণচীণ), হো চি মিন (ভিয়েতনামা) প্রমুখ নেতার বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত এর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ৩০ শে অক্টোবর ২০১৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্বঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’ এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা/বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক দু’বছর ধরে প্রামাণ্য দালিলিক যাচাইবাছাই শেষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের সম্মতিক্রমে এটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চুড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ফলে বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানএর বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রণোদনাময় ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়। স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত ৩০ লক্ষ শহীদ আর সম্ভ্রম হারানো কয়েক লক্ষ মাবোনসহ আমাদের সকলের জন্য এটি এক মহাআনন্দ ও বিরল সম্মানের ঘটনা।

৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ সমূহের অন্যত হিসেবে চিহ্নিত। কার যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণ মাত্রই প্রচণ্ড উদ্দীপনীয় মুহূর্তে মানুষকে নব চেতনায় জাগিয়ে তুলে অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তাদের প্রস্তুত রাখতে সক্ষম। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে।

কোনোরূপ আপসকামিতার পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়াদিয়ে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লক্ষ লোক আত্মোৎসর্গ করে এবং ২ লক্ষ মাবোন সম্ভ্রম হারায়, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন।

ইতিহাসের বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ এ ভাষণের মূল্য লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসনশোষণের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা। সময়ে পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে এ ভাষণটি কালোত্তীর্ণ ও সকল সময়ের জন্য প্রেরণাদায়ী ভূমিকা পালন করে আসছে। কাব্যিকতা, শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে ভাষণটি হয়ে উঠেছে গীতিময় ও শ্রবণে চর্তুদিকে অনুরণিত। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েন্ট অব পলিটিক্স’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণটি লিখিত ছিল না এবং আকারে তা ছিল নাতিদীর্ঘ।

আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ এড্রেসের’ শব্দসংখ্যা ২৭২ সময় ছিল ৩ মিনিটেরও কম। অপর দিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সময় ছিল ১৮ মিনিট শব্দ সংখ্যা ১,১০৫ (এক হাজার একশত পাঁচ) এবং মার্টিন লুথার কিং এর ভাষণের সময় ছিল ১৭ মিনিট শব্দ সংখ্যা ছিল ১৬৬৭।

১৯ মিনিটের এই ভাষণই বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। বাঙালিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত ও দিক্ষিত করে। এমন ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। আর এ জন্যই এটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটির তুলনা শুধু এটিই। এমন গতিময়, তাৎপর্যময়, সুদূঢ় প্রসারী ভাষণ ইতিপূর্বে কোনো নেতা দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।

সব দিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এক অনন্য সাধারণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত এবং মানবজাতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে গৃহীত। ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব স্বীকৃতির ফলে শুধুমাত্র বাঙালি নয় বিশ্ব মানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ, গণতন্ত্র, উচ্চ মানবিকতা, ত্যাগ, দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জাতিভেদবৈষম্য ও জাতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা যোগাবে। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে নবীন প্রজন্ম, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী সকলের জন্যই এ ভাষণে রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি জাতিজনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি, এক মহাকাব্য, বাহুমাত্রিকতায় তা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য।

তথ্য সূত্র ঃ () হারুনঅর রশিদ লিখিত, ৭ই মার্চের ভাষণ কেন বিশ্বঐতিহ্য সম্পদ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমি, ২০১৯২০২০। () ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জনক আমার নেতা আমার’ শেখ হাসিনা, চারুলিপি প্রকাশন২০২১।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধআমার বাংলাদেশ