এটি সর্বজনবিদিত যে, মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা ছিল বাঙালি মুক্তির ম্যাগনাকার্টা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদল সমূহের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিকদের ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “আমার প্রস্তাবিত ছয় দফা দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি শোষিত, বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই।” জাতীয় কবি নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতার পংক্তিগুলোর যেন জোরালো অনুরণন ছিল বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যে – ‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ ?/ নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ও ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে পাকিস্তানি নিকৃষ্ট শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীন উপনিবেশ হিসেবেই চিহ্নিত করে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক সকল ক্ষেত্রে প্রচন্ড অমানবিক শোষণ-দমন ও নিপীড়নের পন্থা বেছে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ অঞ্চলে পরিণত করার কুৎসিত কৌশল অবলম্বন করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভিনব বিকাশমানতায় পূর্ণাঙ্গ পরিপুষ্ট এই ছয় দফা ছিল দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক বৈতরণী। ছয় দফার পক্ষে অদমনীয় বাঙালির প্রগাঢ় সমর্থনে তীব্র গণআন্দোলন সূচনা ও দাবী আদায়ে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে শহীদ মনু মিয়া–শফিক-শামসুল হকসহ ১০ জন বাঙালির প্রাণ বিসর্জন আন্দোলনের বারব্রত তৈরি করে।
তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ছয় দফা আন্দোলনকে ‘বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ হিসেবে কলুষিত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মামলা দায়ের করে ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাঁকে গ্রেফতার করা হলে ৬ জুন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দীদের মুক্তি ও স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে হরতাল আহবান করা হয়। ৭ জুন ১৪৪ ধারা জারি করে কঠোর গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কারণে ৮ জুনের পত্রিকায় এ সম্পর্কিত কোন সংবাদই প্রকাশিত হয়নি। ১৫ জুন ইত্তেফাক সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার ও ইত্তেফাক পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
এই ছয় দফা আন্দোলনকে ঘিরে অভূতপূর্ব সংগ্রামের দাবানল পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ভিতকে কঠিন নির্বীজ নড়বড়ে করে তুলে। ভীত সন্ত্রস্ত শাসকগোষ্ঠী ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ নামে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা দায়ের করে বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এর বিরুদ্ধে হিংস্র স্বৈরশাসকের নরপশুতুল্য বাহিনীদের সমস্ত রক্তচক্ষু-কুৎসিত আক্রমণ-গুলি বর্ষণের ভয়কে জয় করে হাজার হাজার ছাত্র জনতা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করে। ‘জেলের তালা ভাঙ্গব, শেখ মুজিবকে আনব। তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ স্লোগানের প্রতিভায় উজ্জীবিত আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। ছাত্রনেতা আসাদ, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. সামসুজ্জোহা, স্কুল ছাত্র মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক’র রক্তে রঞ্জিত আন্দোলনের তীব্রতা অনুভব করে শাসকগোষ্ঠী ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নি:শর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
এর পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বিশাল ছাত্র জনতার অকুন্ঠ সমর্থনে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। উল্লেখ্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদী ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার মাত্র দশ পয়সা মূল্যের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে স্বাধীনতার ইতিহাসে গণমাধ্যমের পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সেই দিন আজাদী পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনের মুখে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিলাভ-আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার’। একই পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘চট্টগ্রামে খুশীর হিল্লোল’। তৎকালীন আজাদীর সম্পাদক পরম শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ খালেদ এবং পরিচালনা সম্পাদক সম্মানিত এম এ মালেক এজন্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আজীবন গৌরবদীপ্ত হয়ে থাকবেন।
কথিত এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ‘জবানবন্দি’ ছিল বিশ্ব ইতিহাসের সর্বোচ্চ নন্দিত অসাধারণ অন্যতম দলিল। এই জবানবন্দিতে বঙ্গবন্ধু বিদ্যালয় জীবনের সূচনা থেকেই ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নিরলস সংগ্রামে তাঁর অংশগ্রহণ এবং শিক্ষা জীবন বিসর্জনের কথাও ব্যক্ত করেছেন। ১৯৪৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ গঠন, ১৯৫৪ সালে প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদ ও পরে জাতীয় বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত এবং দুইবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারে মন্ত্রীত্ব লাভের কথাও উল্লেখ করেন।
জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সাল থেকে পাকিস্তানের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, পাকিস্তানের সম্মিলিত বিরোধী দলের অঙ্গ দল হিসেবে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন, ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে গভীর নিন্দা প্রকাশ এবং সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপনের কথা বঙ্গবন্ধু অকপটে উক্ত জবানবন্দিতে সুস্পষ্ট করেন, যুদ্ধাবসানে অন্যান্য রাজনীতিকদের সাথে আমন্ত্রিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাতের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আবেদন জানান।
সকল আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মিমাংসা হওয়া উচিত বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর দল ‘তাসখন্দ ঘোষণা’ সমর্থন করেন। অত্যন্ত সুনিপুন বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার সাথে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই জবানবন্দিতে ছয় দফা কর্মসূচি প্রণয়ন-উপস্থাপন এবং এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের বক্তব্যে অবিস্মরণীয় গৌরবগাঁথায় নিজেকে অভিষিক্ত করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এবং তাঁর দলের কর্মীদের নিপীড়ন-নির্যাতন-গ্রেফতারি পরোয়ানা-কারাবরণ ইত্যাদির দু:সহ দিনলিপির ঘটনাও তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জবানবন্দিতে যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন; তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শীর্ষে থাকা জনাব তাজুদ্দীন আহাম্মদ, খোন্দকার মুশতাক আহাম্মদ, জনাব মুজিবুর রহমান, চট্টগ্রামের জনাব আজিজ, জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী, জনাব জহুর আহাম্মদ চৌধুরী, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, জনাব মোমেন এডভোকেট ও ওবায়দুর রহমান।
এছাড়াও রয়েছেন ঢাকার জনাব শামসুল হক, জনাব হাফিজ মোহাম্মদ মূসা, মোল্লা জালালউদ্দিন আহম্মদ এডভোকেট, ক্যাপটেন মনসুর আলী, জনাব আমজাদ হোসেন, এডভোকেট আমিনুদ্দিন আহম্মদ, পাবনার এডভোকেট আমজাদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জের জনাব মুস্তফা সরোয়ার ও জনাব মহিউদ্দিন আহম্মদ, জনাব মোহাম্মদুল্লাহ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। বঙ্গবন্ধুর এই তালিকায় আরো রয়েছেন ঢাকার জনাব সিরাজউদ্দিন আহম্মদ, জনাব হারুনুর রশীদ, জনাব শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, জনাব আবদুল হাকিম, জনাব রশীদ মোশারফ, জনাব সুলতান আহম্মদ, জনাব নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের জনাব আবদুল মান্নান, পাবনার এডভোকেট হাসনাইন, মোমেনশাহীর জনাব আবদুর রহমান সিদ্দিকী, বঙ্গবন্ধুর দুই ভ্রাতৃষ্পুত্র শেখ ফজলুল হক ও শেখ শহীদুল ইসলাম, জনাব তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, চট্টগ্রামের জনাব ইদ্রিসসহ অন্যান্য বহু আওয়ামী লীগ কর্মী, ছাত্রনেতা ও শ্রমিক নেতা।
বঙ্গবন্ধু বিচারকার্য শুরুর একদিন পূর্বে ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন, এডভোকেট জনাব আবদুস সালাম খানের সহিত সাক্ষাৎ করে তাঁকে অন্যতম কৌসুলি নিয়োগ করেন। অত্যন্ত জ্ঞানাঙ্কুর মেধাবী অভিজ্ঞ রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু অন্যান্য নেতা কর্মীদের এই মামলা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তাঁদের সাথে কোন ধরনের সাক্ষাত হয়নি মর্মে জবানবন্দিতে বক্তব্য প্রদান করেন। এদের মধ্যে ছিলেন লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেন, লে. মোজাম্মেল হোসেন, এক্স-কর্পোরাল আমির হোসেন, এল. এস. সুলতান উদ্দিন আহম্মদ, কামালউদ্দিন আহাম্মদ, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেট মাহফুজ উল্লাহ্ ও এই মামলায় জড়িত অন্যান্য স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারিবৃন্দ। সরকারি আমলা বিশেষ করে জনাব আহম্মদ ফজলুর রহমান, জনাব রুহুল কুদ্দুস ও জনাব খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান’র সাথে কখনো কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা বা ষড়যন্ত্রেও ব্যাপৃত হন নাই মর্মে জবানবন্দি দেন। চট্টগ্রামের ডাক্তার সাঈদুর রহমান ও মানিক চৌধুরীকে এই কথিত ষড়যন্ত্রে সাহায্য করতে বলেন নাই এবং তারা চট্টগ্রামের অন্যান্য সাধারণ কর্মীদের ন্যায় মাত্র উল্লেখ করে অভিযুক্ত সকল নেতাকর্মীদের এই মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদানকল্পে জবানবন্দিতে প্রাণান্তর প্রচেষ্টার অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রদত্ত জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘বর্তমান মামলা নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নহে। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শোষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্রের জাল বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিস্তার করিয়াছে এই মামলা তাহারই বিষময় প্রতিক্রিয়া। আমি কখনো পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিছিন্ন করিবার জন্য কোনো কিছু্ করি নাই কিংবা কোনদিনও এই উদ্দেশ্যে কোনো স্থল, নৌ বা বিমানবাহিনীর কোনো কর্মচারির সংস্পর্শে কোনো ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করি নাই। আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণরূপে অজ্ঞ। তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’ স্বল্প পরিসরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিস্তারিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারছিনা বলে আমি সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে আমার লেখায় ঘটনার নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারী নেতাকর্মীদের সামগ্রিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।