জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটি কেবল একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সত্তা, একটি ইতিহাস এবং বাংলা ও বাঙালির গর্বের ধন। এক কথায় বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি থাকবে, তত দিনই বঙ্গবন্ধু আমাদের আদর্শের উৎস হয়ে অম্লান থাকবেন।
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ ও কিউবা। সেই সম্মেলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ হয়। সেই সাক্ষাতে তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এঙপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’ তাঁর এই কথাটির অর্থ হলো, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’
আগামী ১৭ মার্চ বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১ তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বাঙালি জাতির মুক্তির দিশা হয়ে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তিনি ভাষা-সৈনিক, বাঙালি জাতির পিতা এবং বাঙালির অধিকার ও স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর নেতৃত্বেই বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তিনি বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ, দিয়েছেন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও লাল সবুজের একটি পতাকা।
বঙ্গবন্ধুর পিতা ছিলেন শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন। তাদের চার কন্যা এবং দুই পুত্রের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয়। বাবা মা তাঁকে আদর করে ডাকতেন খোকা। কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ফুটে উঠে দেশপ্রেম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা। এই সময়ে তিনি প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে তৈরি করেন। বঙ্গবন্ধু যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন ছাত্রদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। এ ভাষণের জের ধরে তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য সংগ্রামী জীবনে এটিই ছিল প্রথম গ্রেফতার। পুলিশ গ্রেফতার নিয়ে যাওয়ার সময় বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের তোপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক একদিন গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশনারি হাই স্কুল পরিদর্শনে আসেন। এসময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনকালে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে ছিলেন শীর্ষ রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সে সময় শেরেবাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্কুলের ছাদ মেরামতের জোর দাবি জানান। পরে বঙ্গবন্ধুর দাবি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হন এ কে ফজলুল হক। সেদিন রাজনীতির এই দুই দিকপাল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ভবিষ্যত নেতৃত্বের গুণ দেখতে পেয়েছিলেন।
টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ির কাছারি ঘরে মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের কাছে শিশু বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনার হাতেখড়ি। গৃহশিক্ষক মৌলভী সাখাওয়াৎ উল্লাহর কাছে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। ১৯২৭ সালে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন যখন বঙ্গবন্ধুর বয়স ৭ বছর। ১৯৩১ সালে পিতা পরিবার নিয়ে চলে আসেন তাঁর কর্মস্থল গোপালগঞ্জে। বঙ্গবন্ধুকে ভর্তি করে দেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে।
এখানে কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হন বেরিবেরি রোগে। এ রোগ থেকেই তাঁর চোখে সমস্যা দেখা দেয়। তখন সকলের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে যান পিতা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিশেজ্ঞ তাঁর চোখের সার্জারি করেন। এরপর চিকিৎসক তাঁকে চোখে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। চোখের এই অসুখের কারণে বঙ্গবন্ধু চার বছর বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ এস. এম. মডেল হাই স্কুল থেকে মাট্রিক পাস করেন। বিএ পাস করেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় এসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন আইনশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু পড়াশোনার থেকে রাজনীতি বেশি করেছেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা তাঁকে বাধা দেননি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এতো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না।’
এদিকে বঙ্গবন্ধু ছোটদের খুব ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। শিশুদের সবকিছুকে সহজে বুঝতে পারতেন তিনি। তিনি দেখলেন, কোনো ছেলে ভীষণ গরিব, টাকার অভাবে ছাতা কিনতে পারে না, রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট পাচ্ছে, অমনি তাঁর ছাতাটা দিয়ে দিতেন। কিংবা টাকার অভাবে কোনো ছেলে বইপত্র কিনতে পারছে না, দিয়ে দিলেন নিজের বইপত্র। এমনকি একদিন নাকি এক ছেলেকে ছেঁড়া কাপড় পরে থাকতে দেখে নিজের পরনের কাপড় খুলে দিয়েছিলেন তিনি। শৈশব থেকেই তার বড় হৃদয় এবং ছোট-বড় সবার জন্য দরদি মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
শিশুদের প্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধু শিশুদের কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট) জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়। শিশুদের প্রতি সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন- আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে আজকের শিশুদেরই। তাই শিশুরা যেন সৃজনশীল, মননশীল এবং মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে- তিনি সব সময় সেটাই কামনা করতেন। কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘর ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সংগঠন। কৈশোরে কন্যা শেখ হাসিনাকে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) কচিকাঁচার আসরে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের শেষ দিনটি তিনি কাটিয়েছেন এই সংগঠনের ভাই-বোনদের সাথে।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এই দুই সত্তাকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশকে জানতে হলে, বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হবে এবং জানতে হবে বঙ্গবন্ধুকে। তিনি তিলে তিলে একটা অসামান্য স্বপ্নের বীজ বাঙালির মনে গেঁথে দিয়েছেন খুবই সাফল্যের সঙ্গে। সেই স্বপ্নটি হলো বাংলাদেশ নামে বাঙালির আলাদা একটি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের মানুষ কথা বলবে মায়ের ভাষায়। সেই ভাষা হবে বাংলা। বাঙালির সেই স্বপ্নদ্রষ্টার নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।